৮ এপ্রিল ২০২০, বিন্দুবাংলা টিভি. কম, ডেস্ক রিপোর্ট :
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার একমাস হচ্ছে বুধবার (৮ এপ্রিল)। মঙ্গলবার (৭ এপ্রিল) পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের। খবর: বিবিসি বাংলা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩৩ জন। মঙ্গলবারই ৪১ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করার তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পরীক্ষার হার যত বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
একমাসের পরিস্থিতি কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সী বলেন, পশ্চিমা দেশ নয়, আমরা ভারত বা ব্রাজিলের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তখন কিন্তু দেখা গেছে এরকম একটা পর্যায়ে এসে তাদের রোগীর সংখ্যা বহু হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদেরও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সেরকম একটা চিত্র দেখতে হবে।
‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেজন্য প্রস্তুত কিনা? আমরা হয়তো রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম হবো, কিন্তু পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের স্বাস্থ্য খাত কতটা প্রস্তুত হয়েছে? আমাদের কি যথেষ্ট আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, চিকিৎসক প্রস্তুত রয়েছে কিনা। রোগী সামলানোর ব্যাপারটি হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।থ
তিনি বলেন, পরীক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেটাই এখনও প্রকৃত চিত্র কি-না বলা যাবে না। কারণ আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র সবেমাত্র বাড়িয়েছি। এই যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়লে হয়তো আসল চিত্রটা বোঝা যাবে।
‘রোগটি প্রতিরোধ করতে হলে লকডাউনের ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা যত ভালোভাবে আমরা সেটা করতে পারবো, ততো স্বাস্থ্য খাতের ওপর চাপ কম পড়বে। সেজন্য ত্রাণ, আইনশৃঙ্খলা, মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীয় সমন্বয় ব্যবস্থা থাকা দরকার।
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলছেন, যেভাবে সবকিছু হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি। কোয়ারেন্টিনের কথাই যদি বলেন, বিদেশ থেকে যারা এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টিন ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি অনেকের নাম ঠিকানাও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। প্রথমেই আমরা সেই সুযোগটা মিস করেছি।
‘টেস্ট করার সক্ষমতা থাকার পরও এতোদিন পরে টেস্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রথম থেকে যদি সেটা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে ধরা যেতো, ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেটাও ঠিক সময়ে করা হয়নি।থ
‘যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিংও ঠিকভাবে হয়নি। তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কি করেছেন, সব বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। তাহলে ঝুঁকি অনেক কমতো। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি- সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সেটা করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জরুরি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, প্রথম থেকেই রোগটি ব্যবস্থাপনায় একটা সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। শুধু একটা জায়গায় টেস্ট সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, অনেক দেরি করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন রোগীর সংখ্যা কমিয়ে রাখার একটা চেষ্টা করা হয়েছে।
‘এখনও এক্ষেত্রে একটা সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এখন যে রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তারা কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে, তা নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে।থ
রোগীর সংখ্যা যতো বাড়বে, ততো এই পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
প্রথম রোগী শনাক্ত
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ই মার্চ। সেদিন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ।
তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
তিনি জানিয়েছিলেন, আক্রান্তদের মধ্যে দুইজন ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। দেশে আসার পর তাদের লক্ষ্মণ ও উপসর্গ দেখা দিলে তারা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। পরে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হলে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে।
ইতালি থেকে আসা ওই দুইজন দুইটি আলাদা পরিবারের সদস্য। তাদের নমুনা সংগ্রহের সময় পরিবারের আরও চারজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই চারজনের মধ্যে একজন নারীর করোনাভাইরাস ধরা পড়ে।
এই ঘোষণা আসার পর মাস্ক, স্যানিটাইজারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত দাম রাখার কারণে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি সিলগালা করে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আর নতুন কোন রোগী পাওয়ার খবর জানায়নি আইইডিসিআর।
১১ই এপ্রিল সংস্থাটি জানায়, যে তিনজন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজন সুস্থ হওয়ার পথে। আরেকটি পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে তারা সুস্থ জানিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে।
একই দিন করোনাভাইরাসকে মহামারি বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
১৩ই মার্চ আইইডিসিআর জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। নতুন রোগী পাওয়া যায়নি।
তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি হটলাইন নম্বর চালু করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। তবে অনেকেই অভিযোগ করেন, বারবার চেষ্টা করেও তারা এসব হটলাইনে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল
এর আগের কয়েকমাস ধরেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু যেদিন প্রথম রোগী শনাক্ত হয়, ৮ই মার্চ সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সীমিতভাবে উদযাপিত হবে। বড় পরিসরে জনসমাগম করা হবে না। ১৭ই মার্চের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানটিও বাতিল করা হয়।
কম পরীক্ষা, কম রোগীর অভিযোগ
১৭ই মার্চ সংস্থাটি জানায় যে, আগের ২৪ ঘণ্টায় তারা ২৪জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৮৭ জনের।
নমুনা পরীক্ষার হার এতো কম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, করোনাভাইরাসের উপসর্গ থাকা অনেক ব্যক্তিকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না।
আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তারা পরীক্ষা করাতে পারছেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষারথ ওপর জোর দিচ্ছে, সেখানে আইইডিসিআর শুধুমাত্র তাদের পরীক্ষা করেছে, যারা বিদেশ থেকে এসেছেন অথবা বিদেশ ফেরত কারো সংস্পর্শে এসেছেন।
হাসপাতাল আছে, প্রস্তুতি নেই
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ঢাকায় পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত করার ঘোষণা দেয়া হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে।
হাসপাতালগুলো হলো- মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।
কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, এসব হাসপাতালে প্রস্তুতির এখনো অনেক বাকি। অনেক হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগবে বলে জানায়।
অনেক রোগী অভিযোগ করেন, ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি বা নিউমোনিয়ার মতো রোগে তারা সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। করোনাভাইরাস সন্দেহে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও ওঠে।
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে
১৪ই মার্চ আইইডিসিআরের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, দেশে আরও দুইজন ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
তিনি জানান, লক্ষ্মণ উপসর্গ দেখা দেয়ার পর তাদের আইসোলেশনে আনা হয়েছিল। তাদের একজন ইতালি, আরেকজন জার্মানি থেকে দেশে এসেছেন।
১৬ই মার্চ জানানো হয়, নতুন করে একজন নারী ও দুই শিশু করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় আটজনে।
পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, আক্রান্তদের মধ্যে এক নারী ও দুই শিশু রয়েছেন। আক্রান্তরা দ্বিতীয় দফায় শনাক্ত হওয়া দুজনের মধ্যে এক জনের পরিবারের সদস্য। আক্রান্ত দুজনেই সম্প্রতি বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
পরদিন ১৭ই মার্চ আরও দুইজন আক্রান্ত হওয়ার খবর জানানো হয়।
আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয় আক্রান্তদের সবাই বিদেশফেরত অথবা তাদের পরিবারের সদস্য।
এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ জনে।
স্কুল-কলেজ বন্ধ
১৬ই মার্চ বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, ১৮ই মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সব স্কুল ও কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ১৭ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকীর ছুটির সঙ্গে মিলে কার্যত পরদিন থেকেই ছুটি শুরু হয়।
পরবর্তীতে অবশ্য সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে এই ছুটি আরও বেড়ে যায়।
করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যু
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ই মার্চ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানায়, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ওই ব্যক্তি আজ বুধবার (১৮ মার্চ) মৃত্যুবরণ করেছেন।
তিনি নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন উল্লেখ করে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, তাঁর কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসে সমস্যা এবং হার্টের অসুখ ছিল। হার্ট সমস্যার কারণে সম্প্রতি তাকে রিংও পরানো হয়।
তিনি গত কয়েকদিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন।
আইইডিসিআর পরিচালক জানান, বিদেশফেরত সত্তরোর্ধ ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কারণে আরও একজন আক্রান্ত হয়েছিলেন।
এদিন আইইডিসিআর জানায় বাংলাদেশে আরও চারজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে দুজন ইতালিফেরত, অন্যজন কুয়েত থেকে এসেছেন।
পরদিন আরও তিনজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য জানানো হয়। এদের তিনজনই বিদেশফেরতদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়েছেন।
২০শে মার্চ আরও তিনজন সংক্রমিত হওয়ার তথ্য জানায়। তারা সবাই ইতালিফেরত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়।
এ নিয়ে দেশটিতে মোট সংক্রমণ দাঁড়ায় ২০ জনে।
দশ দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল ও ভিসা বন্ধ
শনিবার (২১ মার্চ) সরকারের এক ঘোষণায় জানানো হয়, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দশটি দেশের সঙ্গে সবরকম বিমান চলাচল ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
এসব দেশ হলো- কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর এবং ভারত। এসব দেশ থেকে যাত্রীবাহী কোন বিমান বাংলাদেশে নামতে দেয়া হবে না। এর ফলে কার্যত আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বাংলাদেশ।
তবে যুক্তরাজ্য, চীন, হংকং ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে বিমান চলাচল অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
এর আগে ১৪ই মার্চ ইউরোপ থেকে বাংলাদেশে সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়।
প্রথমে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পরে সেটি বাড়িয়ে ১৪ই এপ্রিল করা হয়।
১৪ই মার্চ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এক ঘোষণায় জানান, ইউরোপ থেকে ফ্লাইট আসা বন্ধের পাশাপাশি যেসব দেশ বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসা দেয়া বন্ধ রেখেছে, তাদের জন্য বাংলাদেশ ভিসা দেবে না। সেই সঙ্গে সব দেশের নাগরিকদের জন্য অন-অ্যারাইভাল ভিসাও বন্ধ থাকবে।
সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬শে মার্চ, সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে চৌঠা এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে সেই ছুটি বাড়িয়ে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।
এ সময় সকল প্রকার যানবাহন, রেল, নৌ ও বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সারা দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
যদিও যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করার আগেই বিপুল মানুষের ঢল নামে, যারা কোনরকম সামাজিক দূরত্বের পরোয়া না করে বাড়ির পথে রওনা হন।
সাধারণ ছুটির মধ্যে ঔষধ, কাঁচাবাজার ছাড়া সবরকমের দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসব দোকান বন্ধ করার জন্য সময় বেধে দেয়া হয়।
বাতিল করা হয় পহেলা এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা।
শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়ার মুক্তি
২৪শে মার্চ করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দুইটি শর্তে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। নির্বাহী আদেশে এই মুক্তি দেয়া হয়।
শর্ত দুইটি হলো: তিনি বিদেশে যাবেন না এবং বাড়িতে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন।
২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে বেরিয়ে তিনি গুলশানের বাড়িতে যান।
রোগীর সংখ্যা বাড়ছে
২৬শে মার্চ আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশে নতুন করে আরও পাঁচজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে নতুন করে কোন মৃত্যু নেই। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৬ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার কেন্দ্র আরও কয়েকটি বাড়ানোর তথ্যও তিনি জানান।
২৭শে মার্চ আরও চারজন রোগী শনাক্ত করার তথ্য জানায় আইইডিসিআর। নতুন চারজন রোগীর মধ্যে দুথজন চিকিৎসক, যারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন।
পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ
করোনাভাইরাসের কারণে পত্রিকা কেনার হার অনেক কমে যাওয়ায় একাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের কলেবর সীমিত করতে বাধ্য হয়।
মানবজমিন নামের একটি পত্রিকা ২৮শে মার্চ থেকে তাদের প্রিন্টিং বন্ধ করে শুধুমাত্র অনলাইন চালু করে।
৪৮ ঘণ্টায় কোন রোগী নেই
২৮ ও ২৯শে মার্চ আইইডিসিআর জানায় যে, তাদের নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে কোন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়নি।
আক্রান্তদের মধ্যে ১৫জন সুস্থ হয়ে উঠেছে বলেও জানানো হয়।
তবে ৩০শে মার্চ এক ভিডিও কনফারেন্সে আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নতুন করে একজন করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছেন। আর সুস্থ হয়েছেন ১৯জন।
২৪ ঘণ্টায় তারা ১৫৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করতে পেরেছেন।
এদিন সরকারি কয়েকটি হাসপাতালের পাশাপাশি আইসিডিডিআরবিকেও করোনাভাইরাস শনাক্ত করার অনুমতি দেয়া হয়।
৩১শে মার্চ আরও দুইজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কনফারেন্সের সময় বলেন, সাধারণ ছুটি আরও বাড়তে পারে।
পহেলা এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঘোষণা করেন যে আরও তিনজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
পরদিন আরও দুইজন রোগী শনাক্ত করার তথ্য জানানো হয়। তেসরা এপ্রিল পাঁচজন রোগী শনাক্ত করার তথ্য জানানো হয়।
সাধারণ ছুটি বাড়লো
সরকারি এক ঘোষণায় সাধারণ ছুটি আরও একসপ্তাহ বাড়িয়ে প্রথমে ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। পরবর্তীতে সেটি বাড়িয়ে পহেলা বৈশাখের ছুটির সঙ্গে মিল রেখে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এর মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের অনেক কারখানার কর্মীদের কাজে যোগ দেয়ার জন্য কিছু কিছু কোম্পানি নির্দেশ দিলে অসংখ্য কর্মী ট্রাকে, পিকআপে করে, হেটে ঢাকার পথে রওনা দেন।
লোকচলাচল ঠেকাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় যেন, কাউকে ঢাকার ভেতরে ঢুকতে বা বের হতে না দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা ঘোষণা
করোনাভাইরাসের আর্থিক প্রভাব কাটাতে পাঁচই এপ্রিল ৭২,৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রণোদনার এই অর্থ জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূলত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও রপ্তানি খাতের জন্য এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়।
মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
সেখানে বলা হয়ে, শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরা মসজিদে নামাজ আদায় করবেন। বাইরের মুসল্লিরা কেউ মসজিদে জামাতে অংশ নিতে পারবেন না। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে মসজিদে ভিড় করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। অন্য সবাইকে বাসায় নামাজ পড়তে বলা হয়।
বাড়ছে পরীক্ষা, বাড়ছে রোগীর সংখ্যা
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা আরও বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি উপজেলা থেকে অন্তত দুইটি করে স্যাম্পল পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ ঘোষণার পর থেকেই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে রোগী শনাক্ত হারও বাড়ে।
চৌঠা এপ্রিল স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে আর নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে নয়জন।
মীরজাদী সেব্রিনা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নয়জনসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭০ জনে। নতুন আক্রান্তের আটজন ঢাকার। আর একজন ঢাকা বাইরের।
সেব্রিনা বলেন, আক্রান্তদের ৯ জনের পাঁচজনের আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। তারা ইতিমধ্যে সংক্রমণ আছে, এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছেন বা পরিবারের সদস্য। দুজন বিদেশ থেকে এসেছিলেন। আর বাকি দুজনের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পরদিন পাঁচই এপ্রিল জানানো নয়, নতুন করে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে ১৮জন। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ৩৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে তাদের শনাক্ত করা হয়।
ছয়ই এপ্রিল নতুন করে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫জনে। ২৪ ঘণ্টায় মারা যান আরও তিনজন।
সাতই এপ্রিল স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানান, দেশটিতে নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন ৪১জন। আর মারা গেছেন পাঁচজন। একদিনে মৃত্যু বা রোগী শনাক্তের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ। ২৪ ঘণ্টায় ৪৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশে রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১৬৪ জন আর ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই ঢাকার বাসিন্দা বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।