September 17, 2025, 7:25 pm
সর্বশেষ:
মুহূর্তের কবিতা : শাহীন রেজা কুয়েতে প্রবাসী ইলিয়াস মিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু: রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিরাপত্তা কোথায়? হোমনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির অভিযোগে যুবক গ্রেপ্তার তিনটি দপ্তরে দুদকের অভিযান মেঘনায় মুজাফফর আলী হাই স্কুল এন্ড কলেজে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালিত মুরাদনগরে ১৯৫০ পিস ইয়াবাসহ নারী মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে মাদকসহ ৪ ব্যক্তি গ্রেপ্তার ক্রীড়া, স্বাস্থ্য ও কৃষি গবেষণায় অনিয়ম: তিন প্রতিষ্ঠানে দুদকের অভিযান অবশেষে দুদক চিনেছে মেঘনা উপজেলা: জনমনে স্বস্তি, অভিযান অব্যাহত রাখার আহ্বান মেঘনা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের ছদ্মবেশী অভিযান:অনিয়মের সত্যতা মিলেছে

কুয়েতে প্রবাসী ইলিয়াস মিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু: রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নিরাপত্তা কোথায়?

বিশেষ প্রতিনিধি :

নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার সুজাপুর গ্রামের সন্তান ইলিয়াস মিয়া ছিলেন হাজারো প্রবাসী শ্রমিকের একজন, যিনি পরিবার-পরিজনকে সুখে রাখার স্বপ্নে বহু বছর আগে কুয়েতের পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন। গ্রামের মাটিতে একদিন ফিরে আসবেন, পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবেন, সন্তানদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়বেন—এমন প্রত্যাশা বুকে নিয়েই বিদেশের মাটিতে দিনরাত খেটে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দেশে ফেরার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে যখন তিনি কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়েছিলেন, ঠিক তখনই ঘটে গেল এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। দূতাবাসের সামনেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ইলিয়াস মিয়া। জীবনসংগ্রামী এই প্রবাসী শ্রমিক মৃত্যুর পরও সম্মান পাননি যথাযথভাবে। হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে হিমায়িত অবস্থায় পড়ে থাকে দীর্ঘ পাঁচ দিন। এসময় তার সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনরা সর্বত্র খোঁজাখুঁজি করলেও কোনো তথ্য পাননি। অবশেষে ১৫ সেপ্টেম্বর কুয়েতের সোবাহান হাসপাতালে গিয়ে রুমমেটরা তার মরদেহ শনাক্ত করেন।

ঘটনার পর থেকে প্রবাসীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যে প্রবাসীরা দিনরাত পরিশ্রম করে, তাদের জীবন ও নিরাপত্তার প্রতি কি এতই অবহেলা করা হবে? দুর্ঘটনার পরপরই যদি দূতাবাস কর্তৃপক্ষ সক্রিয় হতো, তাহলে মরদেহকে পাঁচ দিন ধরে বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে থাকতে হতো না। প্রবাসীরা প্রশ্ন তুলছেন, বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো আসলে কার স্বার্থে কাজ করছে? নাগরিকদের সুরক্ষা ও মর্যাদা রক্ষায় তারা কেন ব্যর্থ হচ্ছে বারবার?

ইলিয়াস মিয়ার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে নয়, গোটা সমাজকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। তার পরিবারে এখন শোকের মাতম। বাবা-মা হারিয়েছেন সন্তানকে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, সন্তানরা হারিয়েছে বাবাকে। গ্রামের মানুষের মুখেও এখন কেবল হাহাকার—“যে ছেলে আমাদের সবার আশা ভরসা ছিল, সে দেশে ফেরার আগেই লাশ হয়ে ফিরছে।” নড়াইলের প্রত্যন্ত গ্রাম সুজাপুরে এখন কেবল কান্নার রোল উঠেছে। স্বজনদের প্রশ্ন, প্রবাসীরা যদি এভাবে অবহেলিত হয়, তবে তারা আর কাকে ভরসা করবেন?

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস শ্রমিক রেমিট্যান্স। প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে পরিবারকে যেমন স্বাবলম্বী করছেন, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন অসামান্য অবদান। অথচ সেই প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশের মাটিতে নিরাপত্তা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, দুবাইসহ বহু দেশে এরকম দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায় দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উদাসীনতা। ইলিয়াস মিয়ার ঘটনাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

দূতাবাসের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা এমন জায়গায় যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়, তবে প্রবাসীরা আর কোথায় নিরাপদ? প্রশ্ন উঠেছে, দূতাবাসগুলো কি শুধুই আনুষ্ঠানিকতার জন্য বসে আছে? না কি প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষার বদলে তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে? ইলিয়াস মিয়ার মতো একজন সাধারণ শ্রমিকের জীবনের মূল্য হয়তো কারও কাছে খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিটি প্রবাসীই দেশের জন্য অমূল্য। তাদের প্রতিটি ঘাম ও রক্ত বিন্দু দিয়ে গড়ে উঠছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অথচ সেই প্রবাসীর মৃত্যুতে যদি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা দূতাবাসের কোনো সক্রিয় ভূমিকা না থাকে, তবে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বিদেশে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় হতে হবে। প্রবাসীদের তথ্য ভান্ডার বা ডাটাবেইজ আপডেট রাখতে হবে, যাতে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত শনাক্ত করা যায়। পাশাপাশি আইনগত সহায়তা, হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ ও মরদেহ দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই ঘটে না। ফলে প্রবাসীরা ভিনদেশের মাটিতে মৃত্যুর পরও অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হন।

ইলিয়াস মিয়ার মৃত্যুর ঘটনা প্রমাণ করে, প্রবাসীদের জীবনযাত্রা এখনো নিরাপদ নয়। তারা সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, এমনকি কখনো কখনো নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ দেশে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দিয়েই বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সরকার বারবার বলে থাকে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু সেই প্রাণশক্তিকে রক্ষা করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

গ্রামের মানুষ এখন সরকারের কাছে একটাই দাবি তুলেছেন “প্রবাসীদের জীবনের নিরাপত্তা ও মৃত্যুর পর মর্যাদা নিশ্চিত করা হোক।” এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা হাজারো প্রবাসী। তারা বলছেন, সরকার যদি সত্যিই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মূল্যায়ন করতে চায়, তবে শুধু প্রশংসা নয়, তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি দূতাবাসে অভিযোগ নিষ্পত্তি সেল, জরুরি সেবা সেল, এবং দ্রুত শনাক্তকরণ সেল চালু করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।

ইলিয়াস মিয়ার মৃত্যুর পর পরিবারকে এখন শুধু একটাই সান্ত্বনা দেওয়া যায় তিনি দেশের জন্য নিজের শ্রম ও জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু শুধু সান্ত্বনা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যায় না। সরকারের এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আর কোনো প্রবাসী শ্রমিক এভাবে অবহেলার শিকার না হন। কারণ প্রতিটি প্রবাসী শুধু নিজের পরিবারের নয়, গোটা দেশের অর্থনীতির জন্য একেকজন রক্ষাকবচ।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা