October 26, 2024, 9:12 am

অস্বাভাবিক মৃত্যু: ময়নাতদন্তের আগেই কারণ বলে দেয় পুলিশ

ডেস্ক রিপোর্ট।।

.ময়নাতদন্তের আগে সুরতহাল প্রতিবেদনেই পুলিশ বলে দেয় মৃত্যুর কারণ।
.থাকার কথা শুধু লাশের শরীরের জখম ও বাহ্যিক বর্ণনা।

.অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রথম আইনগত প্রক্রিয়া

ময়মনসিংহের ত্রিশালের রামপুরা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন মোনায়েম খান। বছর ছয়েক আগে বাড়ির পাশের একটি গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে তাঁর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যাজনিত’ উল্লেখ করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে দাফন করা হয় লাশ। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে, মোনায়েম খানকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজাতে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছে।

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে সুরতহালে লাশের শরীরের জখম ও বাহ্যিক বর্ণনা থাকার কথা। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ কর্মকর্তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর ‘অনুমাননির্ভর’ কারণ লিখে দেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে সংগ্রহ করা গত কয়েক মাসের ৭০-এর অধিক সুরতহাল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক ঘটনাতেই পুলিশ লাশের জখম ও শারীরিক বর্ণনার পাশাপাশি মৃত্যুর কারণও লিখে রেখেছে। তবে যেসব লাশ অজ্ঞাত ও পচাগলা, সেগুলোর বিষয়ে পুলিশ মৃত্যুর কারণ লেখেনি।

সম্প্রতি পিবিআই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা তদন্ত করেছে এমন ২৩টি ঘটনা পাওয়া গেছে, যেগুলো সুরতহালে ‘আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু’ উল্লেখ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেগুলো হত্যা বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে পুলিশ যে কটি ধাপে আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, সুরতহাল প্রতিবেদন তার মধ্যে প্রথম এবং অন্যতম ধাপ। একজন পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর মৃতদেহটি যে অবস্থায় দেখেন, তার হুবহু বর্ণনা থাকে সুরতহাল প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে লাশের বিষয়ে ১০ ধরনের তথ্য দিতে হয়। সেগুলো হলো—নিহতের নাম-ঠিকানাসহ ব্যক্তিগত তথ্য, লাশ প্রাপ্তির স্থান, শনাক্তকারী সাক্ষী, সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও তাঁর সহযোগীর নাম-ঠিকানা, লাশের শারীরিক বর্ণনা, লাশের দৈহিক অবস্থা, জখমের বর্ণনা, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের কোনো লক্ষণ থাকলে তার বর্ণনা, আঙুলের ছাপ, সুরতহালের সময় উপস্থিত সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করতে হয়।

কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুর আনুমানিক কারণ লিখে দেন সুরতহাল প্রতিবেদনে। আধুনিক এই যুগে মৃত্যুর কারণ জানার অনেক বৈজ্ঞানিক ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া থাকার পরও পুলিশ এটা করে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে ময়নাতদন্ত ও মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ নিয়ে ন্যূনতম কোনো সন্দেহ থাকলে সে বিষয়ে কারও কোনো মন্তব্য করা উচিত নয়। মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ময়নাতদন্ত গ্রহণযোগ্য। কিন্তু পুলিশ যদি তার আগেই কারও মৃত্যুর কারণ বলে দেয়, তাহলে তা ময়নাতদন্ত ও মামলায় প্রভাব ফেলে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানা-পুলিশের করা অন্তত অর্ধশত সুরতহাল প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সুরতহালে মৃত্যুর কারণ লিখে দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। এর মধ্যে একটি পাওয়া গেছে, যেটিতে কেবল মৃত্যুর কারণ লেখা হয়নি।

গত ৩১ আগস্ট ডেমরার নড়াই নদ থেকে অর্ধগলিত একটি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন ডেমরা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহবুব আলম। প্রতিবেদনে তিনি লাশের বিভিন্ন বর্ণনা দেন। তবে এই সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ তিনি উল্লেখ করেননি। এভাবে যেসব মৃতদেহ অর্ধগলিত ও খালি চোখে চেনা যায় না, সেগুলোর মৃত্যুর কারণ লেখে না পুলিশ। এ ছাড়া বাকি মৃত্যুর কারণ তারা লিখে দেয়।

১১ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে খুন হন রবিউল ইসলাম নামের এক যুবক। এই ঘটনায় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই আসআদ বিন আব্দুল কাদির। সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, রফিকুল ইসলামের বুকে এফোঁড়-ওফোঁড় আঘাতের চিহ্ন। তাঁর বাঁ হাতও জখম করা হয়। ধারালো অস্ত্রের গভীর জখমের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই আসআদ বিন আব্দুল কাদির বলেন, ‘আসলে আমরা সম্ভাব্য একটা মৃত্যুর কারণ লিখি। এটা ১০ শতাংশও সঠিক হতে পারে, আবার ৯৯ শতাংশও হতে পারে। এটা লেখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে লিখতে কোনো বারণ নেই।’

এতে ময়নাতদন্তে প্রভাব পড়ে কি না, জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক তাঁর তদন্তে যা পাবেন, তা-ই লিখবেন। এখানে আমাদেরটা তাঁকে নিতেই হবে, বিষয়টা এমন না।’

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদন ময়নাতদন্তের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আমাদের দেশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকেরা ঘটনাস্থলে যেতে পারেন না। তাই তাঁরা ময়নাতদন্ত করার সময় সুরতহাল প্রতিবেদনটি দেখেন। এটা জরুরি। তাই কোনো সন্দেহ থাকলে মৃত্যুর কারণ লেখা উচিত নয়।’

ময়নাতদন্তের আগেই পুলিশ মৃত্যুর কারণ বলে দিলে তা ময়নাতদন্তে প্রভাব পড়ে কি না, জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে যদি সঠিক কোনো তথ্য থাকে, তাহলে সেখানে লেখা ঠিক আছে। তবে অনুমাননির্ভর কারণ লিখলে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশিক্ষণ-২) শেহেলা পারভীন বলেন, ‘পুলিশ কর্মকর্তা মৃতদেহ যেভাবে পান, তারই একটি বর্ণনা সুরতহালে থাকে। সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে মৌলিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণেও এই বিষয়ে শেখানো হয়। এ ছাড়া তাঁরা হাতে-কলমেও শেখেন। সুরতহালে যেসব তথ্য চাওয়া হয়, সেগুলো পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত হয়েই লিখবেন, কোনোটি জানা না গেলে সেটি লিখবেন না। এটাই নিয়ম। এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়।’

সুত্র : দৈনিক আজকের পত্রিকা


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা