July 4, 2025, 6:10 pm

মেঘনায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভুয়া পরিচয়ে চাকরি?

বিপ্লব সিকদার :

মেঘনায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভুয়া পরিচয়ে চাকরি?

একই পিতার নাম, একই ঠিকানা—দুই নারীর দাবি; তদন্তে নেমেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।। 

মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুযোগ নিয়ে ভুয়া পরিচয়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় এমন এক ঘটনা সামনে এসেছে, যা কেবল মুক্তিযোদ্ধার নাম নয়, একই ঠিকানারও দ্বৈত দাবিকে ঘিরে। যার ফলে প্রশ্ন উঠেছে—কে আসল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান?

ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু মেঘনা উপজেলার মানিকারচর ইউনিয়নের বড় নোয়াগাঁও গ্রাম। ওই গ্রামের দুই নারী—শাহিনুর আক্তার ও রত্না আক্তার—দুজনই দাবি করছেন তারা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রবের কন্যা। দুজনেরই পিতার নাম: আব্দুর রব, গ্রাম: বড় নোয়াগাঁও।

চাকরি ও কোটার হিসাব

শাহিনুর আক্তার বর্তমানে মানিকারচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে কর্মরত। তার চাকরির নিয়োগপত্রে উল্লেখ রয়েছে—মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত। অপরদিকে রত্না আক্তার পেশায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনিও একই কোটা থেকে চাকরি পেয়েছেন বলে দাবি করেন।

একই পিতা, তবে কন্যা দু’জন?

স্থানীয়দের দাবি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আব্দুর রব, যিনি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেন। তার স্ত্রী সখিনা বেগম ও কন্যা রত্না আক্তারকে স্থানীয়ভাবে সবাই চেনেন। তবে শাহিনুর আক্তারের দাবি করা আব্দুর রব সম্পর্কে রয়েছে ধোঁয়াশা।

একজন প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,
“আমরা জানি রত্নার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। শাহিনুর যে কিভাবে কোটা পেল, তা আমাদেরও বোধগম্য নয়। অনুমান করি, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এই কাজে সহায়তা করেছে।”

প্রাথমিক তদন্ত ও বিভ্রান্তি

বিষয়টি নিয়ে একসময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেনু দাস একটি প্রাথমিক তদন্ত পরিচালনা করেন। তদন্তে শাহিনুরের তথ্যের সাথে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রবের নাম ও ঠিকানা মিল থাকলেও তার মাতার নাম নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

রিপোর্টে এই দ্বন্দ্ব উল্লেখ করে ইউএনও বিষয়টি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান।

তদন্তে নামছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

সম্প্রতি একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সিভিল সার্জনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চলতি বা পরবর্তী সপ্তাহেই এই টিম মেঘনায় এসে সরেজমিনে তদন্ত পরিচালনা করবে।

তবে অভিযোগ রয়েছে, শাহিনুর আক্তার ইতিমধ্যেই স্থানীয় কিছু মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে ম্যানেজ করে তার পক্ষে মত দিতে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।

পক্ষগুলোর বক্তব্য

রত্না আক্তার বলেন,
“আমি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। জানি তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেই কোটায়ই চাকরি পেয়েছি। ইউএনও অফিস থেকে একবার ডেকেছিল, আমি আমার কথা বলেছি।”

শাহিনুর আক্তারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ফোন নম্বরে কল করলেও বন্ধ পাওয়া গেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সায়মা রহমান বলেন,
“বিষয়টি শুনেছি, তবে এখনো আমাকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি। ফলে অফিসিয়ালি কিছু বলতে পারছি না।”

মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের ন্যায্যতা ও চ্যালেঞ্জ

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্যের সাথেও যোগাযোগ করা হলে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন,
“এখানে অনেক চাপ আছে। কেউ কেউ পরিচিতির সুযোগ নিচ্ছে। তদন্তেই সব পরিষ্কার হবে।”

সচেতন মহলের উদ্বেগ ও দাবি

স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যদি জালিয়াতি হয়, তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো তাদের অধিকার হারাবে।

তারা দাবি করেন,
“এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত করে যদি জালিয়াতির প্রমাণ মেলে, তাহলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না করে এ ধরনের প্রতারণা করতে।”
একই পিতা, একই গ্রাম—তবে কন্যা দুই জন! এই দ্বৈত পরিচয়ের গভীরে রয়েছে কাগজপত্র, মৃত্যু সনদ, মুক্তিযোদ্ধা সনদ, ও সামাজিক স্বীকৃতির জটিল যোগফল।

তদন্ত দল কী খুঁজে পাবে? কে আসল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান? প্রশ্ন এখন কেবল মেঘনার নয়, গোটা ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা