September 15, 2025, 10:39 am

মেঘনায় কৃষি জমি রক্ষায় প্রশাসনের ভূমিকা জোরালো করতে হবে

Group of people Manual Workers Planting Cauliflower in the field Located in Rural India.

বিপ্লব সিকদার :

বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার মূল স্তম্ভ হলো কৃষিজমি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিল্পায়নের চাপে প্রতিদিনই কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের সর্বত্রই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তবে নদীবিধৌত অঞ্চল মেঘনা উপজেলায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট। এখানকার উর্বর জমিতে একসময় সারা বছরের খাদ্য উৎপাদন হতো। আজ সেই জমি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ইটভাটা, অবৈধ শিল্পকারখানা, আবাসন প্রকল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনার দখলে। ফলে স্থানীয় কৃষকরা জীবিকা হারানোর শঙ্কায় ভুগছে এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিজমি রক্ষার জন্য শুধু আইন থাকলেই হবে না, তার কার্যকর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসন যদি কঠোর অবস্থান নেয়, স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তবে মেঘনার কৃষিজমি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। মেঘনায় কৃষিজমি দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ইটভাটা নির্মাণের জন্য বিশাল পরিমাণ উর্বর জমি খুঁড়ে মাটি নেওয়া হচ্ছে। এতে জমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ধোঁয়া ও দূষণে আশপাশের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার আবাসন প্রকল্প ও স্থাপনা নির্মাণের কারণে নদীর পাড় ও উর্বর জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় কৃষকরা আর্থিক চাপে বা প্রলোভনে জমি বিক্রি করে দেয়। অপরিকল্পিত শিল্পায়নও এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলছে। ছোট-বড় কারখানা ও গুদাম কৃষিজমির উপর গড়ে উঠছে। শিল্পাঞ্চল নির্ধারণ না থাকায় জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভূমি দখলদারি ও রাজনৈতিক প্রভাব। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কৃষিজমি দখল করছে। সচেতনতার অভাবও বড় কারণ; অল্প টাকার লোভে কৃষকরা বুঝতে না পেরে জমি বিক্রি করছে। কৃষিজমি ধ্বংস হওয়ার পরিণতি ভয়াবহ। খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। কৃষকের জীবিকা সংকট দেখা দিচ্ছে। জমি না থাকায় অনেককে বাধ্য হয়ে অস্থায়ী পেশায় যেতে হচ্ছে। পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে। অর্থনৈতিক ক্ষতিও স্পষ্ট—আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ তৈরি হচ্ছে। এর পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাও দেখা দিচ্ছে, কারণ জমি হারিয়ে কৃষক পরিবারগুলো দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ছে। অথচ দেশে কৃষিজমি রক্ষার জন্য আইন রয়েছে। ভূমি ব্যবহার আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন—সবই বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ দুর্বল। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা টেকসই হয় না। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ছাড় পেয়ে যায়। নিয়মিত মনিটরিং নেই, ভূমি অফিস, কৃষি অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় দুর্বল। এই অবস্থায় প্রশাসনের করণীয় স্পষ্ট। প্রথমত কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। কৃষিজমি কৃষির বাইরে ব্যবহার করলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অবৈধ ভরাট বা স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে হবে। প্রশাসনকে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব ভাটা ভেঙে দিতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। তৃতীয়ত নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে, যাতে কৃষিজমি দখল না হয়। চতুর্থত মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে, যেখানে প্রশাসন, কৃষি অফিস, ভূমি অফিস, জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবিদদের সমন্বয় থাকবে। পঞ্চমত সচেতনতা বৃদ্ধি ও কৃষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে বেশি লাভবান হওয়া যায়, তা কৃষকদের জানাতে হবে। ষষ্ঠত ডিজিটাল ভূমি রেকর্ড চালু করতে হবে যাতে দখল ও ভুয়া কাগজপত্র রোধ হয়। সপ্তমত জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন, কৃষক সমিতি ও গণমাধ্যমকে যুক্ত করতে হবে। জমি রক্ষার আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। সবশেষে বলা যায়, মেঘনা উপজেলার কৃষিজমি ধ্বংস মানে শুধু স্থানীয় কৃষকের ক্ষতি নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন সময় এসেছে প্রশাসনের ভূমিকা আরও জোরদার করার। কৃষিজমি রক্ষা করা মানে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা। প্রশাসন যদি আন্তরিক হয়ে আইন প্রয়োগ করে, সচেতনতা বাড়ায় এবং বিকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তবে মেঘনার কৃষিজমি আবারও সোনালী ধানের শীষে ভরে উঠবে।

লেখক, সাংবাদিক।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা