• সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:১৮ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]

গ্রামে ডাক্তার পরিচয়ের আড়ালে বাড়ছে চিকিৎসা সংকট

বিপ্লব সিকদার / ৩৮ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশের সময় : সোমবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫

গ্রামীণ জনপদে চিকিৎসাসেবা বলতে এখনো অনেকের চোখে একজন মানুষ—যিনি রোগীর নাড়ি ধরেন, প্রেসক্রিপশন লেখেন বা ইনজেকশন দেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই হোক না কেন, পরিচয় একটাই—‘ডাক্তার’। কিন্তু এই সামাজিক স্বীকৃতির আড়ালে গড়ে উঠেছে এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা, যেখানে সচেতনতার অভাব ও পেশাগত সীমা লঙ্ঘন একসঙ্গে জনস্বাস্থ্যের জন্য সংকট তৈরি করছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রামে এমবিবিএস চিকিৎসকের ঘাটতি দীর্ঘদিনের। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার থাকলেও নিয়মিত সেবা না পাওয়া, দূরত্ব ও ভিড়ের কারণে সাধারণ মানুষ বাধ্য হয়ে বিকল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করেন পল্লি চিকিৎসক ও বিভিন্ন ডিপ্লোমাধারী স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রাথমিক চিকিৎসায় তাদের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন তারা নিজেদের সক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেন।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অনেক চেম্বারে চিকিৎসকের যোগ্যতা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা হয়। সাইনবোর্ডে ‘ডা.’ লেখা থাকলেও কোথাও এমবিবিএস, বিএএমএস বা ডিপ্লোমা—কোনোটিই স্পষ্ট নয়। ফলে রোগীর পক্ষে বোঝার উপায় থাকে না, তিনি কার কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এই অস্পষ্টতা একদিকে সচেতনতার অভাবের ফল, অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে এটি পরিকল্পিত বিভ্রান্তি।
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের বিধি অনুযায়ী, কেবল নিবন্ধিত এমবিবিএস চিকিৎসকরাই ‘ডাক্তার’ উপাধি ব্যবহার করতে পারেন। অথচ মাঠপর্যায়ে এই আইন কার্যকর নেই বললেই চলে। ফলে জটিল রোগের চিকিৎসা, উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এবং অপ্রয়োজনীয় ইনজেকশন দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ চর্চা অবাধে চলেছে।
স্বাস্থ্য বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতির বড় ভুক্তভোগী দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। ভুল চিকিৎসার কারণে রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়, ব্যয় বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগী যখন প্রকৃত চিকিৎসকের কাছে পৌঁছান, তখন অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু এসব ক্ষতির হিসাব কোথাও নথিভুক্ত হয় না, ফলে সমস্যার প্রকৃত মাত্রা আড়ালেই থেকে যায়।
প্রশাসনিক দুর্বলতাও এই সংকটকে গভীর করেছে। ভুয়া ডাক্তার শনাক্তে নিয়মিত অভিযান নেই, স্বাস্থ্য বিভাগের মনিটরিং কার্যত সীমিত। স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে অনেক অবৈধ চেম্বার বছরের পর বছর চালু থাকে। এতে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে এবং স্বাস্থ্যখাতে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
বিশ্লেষণে স্পষ্ট, গ্রামে সবাইকে ‘ডাক্তার’ বলা কেবল ভাষাগত সরলতা নয়; এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা। একদিকে এমবিবিএস চিকিৎসকের ঘাটতি, অন্যদিকে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং সর্বোপরি জনসচেতনতার অভাব—এই তিনের সমন্বয়েই তৈরি হয়েছে বর্তমান সংকট।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রাম পর্যায়ে চিকিৎসকের যোগ্যতা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা, প্রাথমিক চিকিৎসার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া এবং ভুয়া পরিচয় ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটবে। নচেৎ ‘ডাক্তার’ পরিচয়ের এই বিভ্রান্তি ক্রমেই গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।

এই জাতীয় আরো খবর দেখুন