১০ জুলাই ২০১৯ বিন্দুবাংলা টিভি . কম, এনামুল কবির মুন্না :
‘ভাই, আমারে জানে মারিস না। গলা যদ্দুর কাটছে সেলাই করলে হয়তো আমি বাইচা যামু। আমারে জানে মারিস না ভাই। তোরা আমার সৎ ভাই হলেও আমি তোদের ছোট বেলায় অনেকবার কোলে নিয়েছি।’
মৃত্যুর আগে এভাবেই সৎ ভাইদের কাছে প্রান ভিক্ষা চাইছিলেন সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার থানার মাইজখোলা নয়াপাড়া গ্রামের আব্দুল আবিজ (৫৫)। ≅আবিজের কথায় মন গলেনি সৎ ভাইদের- গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করেন বড় ভাইকে। আর এই সৎ ভাইয়েরা হলেন- আবুল কাশেম (৩০), আব্দুল আউয়াল (৩৫), আব্দুল মজিদ (৩৮), ফয়জুর রহমান (২৭)।
এ খুনটি করা হয় মূলত জমি নিয়ে বিরোধ থাকা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুন শেষে চার ভাই ও তাদের পরিবারের সদস্যারা হামলা চালায় প্রতিপক্ষের বাড়িতে। প্রান বাঁচাতে প্রতিপক্ষে থাকা দুই ভাই ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী একটি পাকা বাড়িতে। সেখান থেকে দোয়ারা বাজার থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। পরে সৎ ভাইদের আচরণে পুলিশের সন্দেহ হলে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তারা হত্যার কথা স্বীকার করে।
এবার আসি কেন এই হত্যা- সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও মুরুব্বী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে মূলত দুটি বিষয় সামনে আসে। ভাইকে মেরে ফেললে একঢিলে দুই পাখি মারা পড়বে। প্রথমত প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো এবং দ্বিতীয়ত পৈতৃক সম্পদ।
দীর্ঘদিন থেকেই প্রতিবেশী মমিন উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিন ও মইন উদ্দিনের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল আসামিদের। ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে জসিম উদ্দিন ও মইন উদ্দিনের মাছের ঘের এর চারপাশে দেওয়া জালের বেড়া তুলে দেয় আসামিরা। এতে মাছের ঘের থেকে ১৫ লক্ষাধিক টাকার মাছ ভেসে যায়। জালের বেড়া তুলে দেওয়ার সময় দুই ভাইয়ের কাছে হাতেনাতে ধরা পরে আসামিরা। এনিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে দোয়ারা বাজার থানায় মামলা দায়ের করেন জসিম উদ্দিন ও মইন উদ্দিন।
মামলায় সৎ ভাই নিহত আব্দুল আবিজকে আসামি করা হয়নি- কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে আব্দুল আবিজ তাদের সৎ ভাইদের এই সব জায়গা জমি সংক্রান্ত ঝামেলায় নেই। আব্দুল আবিজ নিতান্তই একজন সাদামাটা মানুষ- জীবিকা নির্বাহের জন্য গ্রামে আইসক্রিম ফেরি করেন।
তারপর থেকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে আসামিরা- মামলা তুলে না নেওয়া হলে তাদেরকে আরও বড় মামলায় ফাঁসানো হবে বলে প্রকাশ্যে নানান জনের মাধ্যমে হুমকি দেয় আসামিরা। ঘটনার দিন রাতে চার ভাই আব্দুল আবিজের ঘরে গিয়ে বলে- ভাই, আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে জসিম উদ্দিন ও মইন উদ্দিন। ঘরে থাকলে পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে। আমরা তোমার সঙ্গে ঘুমাবো।
সৎ ভাইয়েরা কখনও আব্দুল আবিজের বাড়িতে না আসলেও ভাইদের বিপদের কথা চিন্তা করে ঘরে বিছানা পেতে দেন তিনি। রাতে নিজেদের সুবিধামত সময়ে আব্দুল আউয়াল, আব্দুল মজিদ, ফয়জুর রহমান হাত পা চেপে ধরলে আবুল কাশেম আব্দুল আবিজের গলায় ছুরি দিয়ে জবাই করা শুরু করে। এ সময় আব্দুল আবিজ বাঁচার জন্য ভাইদের কাছে অনুনয় বিনয় করলেও সৎ ভাইদের মন গলাতে পারেন নি।
হত্যা করে লাশ রেখে পালিয়ে যায় চার ভাই- সকালে পাশের লোকেরা তাকে ডাকতে গেলে ঘরে রক্ত এবং আব্দুল আবিজের গলাকাটা লাশ দেখে চিৎকার দেন। তাদের চিৎকারে আশপাশের মানুষ এসে পুলিশে খবর দেন- পুলিশ এসে লাশের সাথে সাথে চার সৎ ভাই (আব্দুল আউয়াল, আব্দুল মজিদ, ফয়জুর রহমান, আবুল কাশেম) ও জসিম উদ্দিন ও মইন উদ্দিন সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় নিয়ে যায়।
সৎ ভাইদের আচার আচরণ ও কথাবার্তা অসংলগ্ন হওয়ায় তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে এক পর্যায়ে তারা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে। পরে নিহতের ছেলে মোস্তাকিম (১৮) বাদী হয়ে সৎ চাচাদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
দোয়ারাবাজার থানার ওসি (তদন্ত) বেলায়েত হোসেন জানান, ঘটনাস্থল থেকে নিহত আব্দুল আবিজের গলাকাটা লাশ উদ্ধার এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন হিসেবে নিহতের সৎ ভাইদেরসহ আরও দুজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসি। পরে আসামিরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।