April 15, 2025, 5:51 pm

অন্তর্বর্তী সরকার আলোচনায় সরকারের মেয়াদ

ডেস্ক রিপোর্ট।।

এনসিপিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ফেসবুকে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে প্রচার।

জাতীয় নাগরিক কমিটির ফেসবুক গ্রুপে ২০২৯ সালে নির্বাচন নিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এই প্রচারকে নির্বাচন বিলম্বিত করার পাঁয়তারা হিসেবে দেখছে।

বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাবে দলগুলো আশ্বস্তও ছিল। তবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে বিভিন্ন মহলের প্রচার ও জনমত গঠনের চেষ্টা তাদের ভাবনা বদলে দিয়েছে। নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার সংশয় দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। এই সংশয় কাটাতে দলটি ১৬ এপ্রিল বৈঠকে বসবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।

বিএনপির সমমনা কয়েকটি দলও অন্তর্বর্তী সরকার পাঁচ বছর মেয়াদে থাকার পক্ষে প্রচারকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। কোনো কোনো দলের নেতারা এই প্রচারকে আমল না দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কথায় আস্থা রাখতে চাইছেন। ড. ইউনূস গত শনিবারও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা গত ২৯ মার্চ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জানান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।

১০ এপ্রিল সুনামগঞ্জে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাস্তা থেকে মানুষ বলে যে আপনারা (সরকার) আরও পাঁচ বছর থাকেন।’ এর দুই দিন পর কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সে পাওয়া এক চিরকুটে এই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করার বাসনা জানানো হয়। এনসিপিসহ কয়েকটি সংগঠনের ফেসবুক পেজে সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে প্রচার ও জনমত গঠনের চেষ্টা লক্ষ করা গেছে।

হঠাৎ সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে এমন প্রচার রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ধারণা দেওয়া সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

সরকারের মেয়াদ নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে ভাসানী অনুসারী পরিষদের প্রতিনিধি সম্মেলনে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, মানুষ নাকি বলছে, মানুষ তাঁদের পাঁচ বছরের জন্য চায়, আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, এটা কি তিনি শোনেন না।’ সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। তবে একটা নির্বাচিত সরকারের রিপ্লেসমেন্ট তো আপনারা হতে পারেন না।’

সারজিস আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টে লেখেন, ‘প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন স্টেটসম্যানকে পাঁচ বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবন থাকবে।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের আরেকটি দল জাতীয় নাগরিক কমিটির ফেসবুক গ্রুপে এক পোস্টে মতামত চেয়ে বলা হয়েছে, ‘২০২৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন ঘোষণা করা যেতে পারে। কী বলেন আপনারা??’ আরেকটি পোস্টে বলা হয়েছে, ‘উই ওয়ান্ট ইউনূস ফর নেক্সট ফাইভ ইয়ারস।’ কয়েকটি পোস্টে সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি গণভোটের দাবিও জানানো হয়েছে।

এমন প্রচারকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দেখছে নির্বাচন বিলম্বের ষড়যন্ত্র হিসেবে। এ নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবস্থান পরিষ্কার করার তাগিদ দিয়েছেন দলগুলোর নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটা অনির্বাচিত সরকার অবশ্যই দীর্ঘ সময় থাকতে পারে না। আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি। এই অবস্থায় আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছি।’ তিনি বলেন, ‘এই দাবি নিয়ে ১৬ এপ্রিল আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে যাব। দেখি, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) কী বলেন।’

বিএনপির অনেক নেতার সন্দেহ, সরকারের মেয়াদ নিয়ে এই প্রচারের পেছনে এনসিপি রয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, এনসিপি আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে দল গোছাচ্ছে। দ্রুত নির্বাচন হলে তারা ভালো কিছু করতে পারবে না জেনে নিজেদের প্রস্তুতির জন্য সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বের পাঁয়তারা করছে।

এনসিপির নেতা সারজিস আলমের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু আজকের পত্রিকাকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই অনেকবার বলেছেন, ছাত্ররাই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সেই ছাত্রদেরই একজন সারজিস আলম। কাজেই সারজিসের বক্তব্য অন্য কিছুরও ইঙ্গিত দিতে পারে। সারজিস নির্বাচনের কথা বলেননি।

বিএনপির সমমনা দলগুলোর অনেক নেতা বলছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করে সরকারসহ বিভিন্ন সংগঠন ও দলের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে। এর ফলে সরকারের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর প্রচারে আদতে সরকারেরই ক্ষতির কারণ হচ্ছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘কোথায় কে কী বলল, এগুলোকে আমলে নেওয়ার কিছু আছে বলে মনে করি না। প্রধান উপদেষ্টা এমন চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। আমি তাঁর ওপর আস্থা রাখতে চাই। ডিসেম্বর বা জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ওপর আস্থা রাখতে চাই।’ তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিতর্কিত করা হচ্ছে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, যদি তাঁকে (ড. ইউনূস) ক্ষমতায় রাখতে চান, তাহলে বলেন, তিনি একটা দল করুন, ভোট করুন। জনপ্রিয়তা থাকলে সবাই মিলে ভোট দেন; আবার পাঁচ বছরের জন্য উনি ক্ষমতায় আসুক। আর যদি উনি ভোট না করেন, তাহলে সবাই মিলে তাঁকে বলেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন, ভালো একটা ভোট দেন।’

সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর প্রচারের সঙ্গে এনসিপির সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। এ-সংক্রান্ত প্রচারকে ‘ব্যক্তিগত’ মন্তব্য করে সারজিসের পোস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সারজিসের আলম বক্তব্যে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। এনসিপি মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার এবং বিচারের দৃশ্যমানতার ভেতর দিয়ে যত দ্রুত সময়ে সম্ভব নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে। নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্কার এবং বিচারের যে প্রক্রিয়া চলমান আছে, তা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর না হয়ে শুধু সময়ক্ষেপণের দিকে যদি সরকার অগ্রসর হয়, তাহলে তাঁরা সেটার বিরোধিতা করবেন।

এনসিপির নেতারা বলছেন, দুই হাজার মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের যে সুযোগ এসেছে, তা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে দেওয়া হবে না। দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের পরেই নির্বাচন হবে—এনসিপি এমনটাই চায়। এনসিপির কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি বর্তমানে সংস্কারের কথা বললেও নির্বাচনের পর সংস্কার ও বিচার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলতে পারে। তাই সংস্কারপ্রক্রিয়া বিলম্ব হলেও পরিপূর্ণ সংস্কার শেষেই নির্বাচন চায় এনসিপি। এনসিপি সরকারের সময়সীমা নয়, আওয়ামী লীগের বিচার ও সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বেশি মনোযোগী।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেউ সরকারের বর্ণিত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন চাইছে, কেউ আরও দীর্ঘ মেয়াদে সরকার থাকুক, সেটা চাইছে। প্রত্যেকেরই স্বাধীন মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সংস্কারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং তা চূড়ান্ত করার জন্য যে নির্বাচন দরকার, সেটা এই সময়সীমার মধ্যে আমরা মনে করি সম্ভব।’

এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য যে সময় সরকার চেয়েছে, সেই সময় জামায়াত দেবে।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা