নিজস্ব প্রতিবেদক : দিনটি ছিলো ২০১১ সালের ৬ জুলাই। বিএনপির সকাল সন্ধ্যা হরতাল চলছিলো। ভোর ছয়টার দিকে হরতালের সমর্থনে মিছিল করার উদ্দেশ্যে বিরোধী দলীয় চীপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে দলের ২০-২৫ জন সাংসদ মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে জড়ো হন। এক পর্যায়ে তাদের মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়। হঠাৎ করেই পুলিশ জয়নাল আবেদিন ফারুকের উপর অতর্কিতে হামলা চালায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশের তৎকালিন তেজগাঁও বিভাগের সহকারী উপকমিশনার হারুনুর রশিদ আক্রমণাত্মকভাবে জয়নুল আবেদিন ফারুকের উপর হামলা চালান। তার গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলেন এবং মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করেন। বিরোধী দলের একজন চীপ হুইপের উপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলা নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
কিন্তু যতই সমালোচনা হোক না কেনো, তাতে সরকার কিংবা পুলিশ বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। বরং হারুনুর রশিদের উপর সরকার ব্যাপক খুশি হয়েছে বলেই পরবর্তীতে প্রমান হয়েছেন। কেননা, ওই ন্যাক্কারজনক হামলার পর হারুনুর রশিদকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে তার পদোন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি ভূষিত হয়েছেন নানা সরকারি পুরস্কারে।
আজ রোববার নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে তাকে পুলিশ সদর দফতরে বদিল করা হয়েছে। তার নতুন দায়িত্ব পুলিশ সুপার (টিআর)।
২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন অভিযানের নামে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে আটক বাণিজ্যসহ নানা ধরণের বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে নতুনভাবে আলোচনায় আসেন তিনি।
বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের আলোচিত এমপি একে এম শামীম ওসমানের সাথে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। দুইজনই একে অপরের বিরুদ্ধে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে দেশব্যাপী আলাচিত হন।
সবশেষ গত শনিবার ভোর রাতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাশেমের পুত্র বিসিবির সাবেক পরিচালক ও গুলশান ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেলের ব্যবহৃত গাড়ি এবং চালক সুমনকে গ্রেফতার করে। একই সময়ে ৮ কোটি টাকা চাঁদা না দেয়ায় গভীর রাতে বাসায় ঢুকে আম্বার গ্রুপের কর্ণধার শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী ও পুত্রকে তুলে নিয়ে যায়।
শওকত আজিজ রাসেল জানান, আম্বার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের কাছে ৮ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন এসপি হারুন। এই চাঁদা না দেয়ায় শুক্রবার রাতে তার শুলশানের বাসভবনে গভীর রাতে তিনি হানা দেন। তার সঙ্গে ছিলেন ডিবির পোশাক পরা, সাদা পোশাকধারী ও পুলিশের পোশাক পরা ৬০ থেকে ৭০ জন। এ সময় তার বাসা তছনছ করা হয়। তাকে বাসায় না পেয়ে তার স্ত্রী ও পুত্রকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের গুলশান থানায় না রেখে কিংবা কোনো তথ্য না দিয়ে সরাসরি নারায়গঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়।
অভিযোগকারী সূত্রে জানা যায়, এর আগেও এসপি হারুণ দুই দফা এ চাঁদা দাবি করেন। অভিযোগপত্রে শওকত আজিজ রাসেল উল্লেখ করেন, “এসপি হারুন আমাকে গুলশান ক্লাবের লামডা হলে ও গুলশানের কাবাব ফ্যাক্টরি রেস্তোরাঁয় ডেকে নিয়ে দুইবার আমার কাছে চাঁদা দাবি করেন। ওই টাকা ডলারে আমেরিকায় এসপি হারুনের নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠাতে বলেন। টাকা না দিলে আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিম ধ্বংস করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেন।”
অভিযোগে তিনি আরও উল্লেখ করেন, “টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আমার কোম্পানি আম্বার ডেনিম ফ্যাক্টরির ৪৫ জন কর্মীকে গভীর রাতে গাজীপুর থানায় ধরে নিয়ে যান। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠান এসপি হারুন।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদা না দেয়ায় আম্বার গ্রুপের ওপর অসন্তুষ্ট হারুন। আম্বার গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে নানা সময়ে ফোনে ও থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে চাঁদার জন্য হুমকি দেন বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
এর আগে এই হারুন এসপি হিসেবে তিনি প্রথম গাজীপুরে নিয়োগ পান। সেখানকার মানুষ আজও এসপি হারুনের নাম শুনলে ঘৃণায় থু থু ফেলে। আতঙ্কে কারো কারো রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। গাজীপুরে জমি দখল চাঁদাবাজিসহ তার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ থাকলেও সেসব অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি।
গাজীপুরে এসপি হারুনের চার বছরের রাজত্বে মাদক ও আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা ও জুয়ার জমজমাট ব্যবসা চলে। আর এসব অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক এম.এ. মান্নান ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নেপথ্যেও তার ইন্ধন ছিল। জেলার শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা করা হয়েছে। মামলা আর হামলার ভয়ে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঘরছাড়া হয়েছেন। বিএনপির জেলা থেকে ওয়ার্ড- কোনো কার্যালয়ই খুলতে দেননি এই এসপি। দলীয় কর্মসূচী দূরে থাক মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারেনি বিএনপি। জেলা বারের আইনজীবীও এসপি হারুনের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি।
গাজীপুর সিটি মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নানকে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের পৃথক অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে বরখাস্ত করার পেছনে তার অবদান রয়েছেন। স্থানীয়দের তথ্যমতে, চান্দনা এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে যাত্রীবাহী বাসে আগুন ধরে যাওয়ার কথা প্রথমে পুলিশ স্বীকার করে। কিন্তু পরে নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়। অথচ আগুন লাগার অন্তত পাঁচঘণ্টা আগে মান্নানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে পুলিশের লেগুনায় অগ্নিসংযোগ করার ঘটনাও ছিল এসপি হারুনের নির্দেশে পুলিশের একটি ‘নাটক’।
সরকার দলীয়রাও রেহাই পায়নি কুখ্যাত এই এসপির হাত থেকে। সরকার দলীয় কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, নূরুল ইসলাম নূরু, মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি মাসুদ রানা এরশাদ ও তার পাঁচ সহোদরসহ অনেক দলীয় নেতাকর্মী এসপি হারুন কর্তৃক নাজেহাল ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমনকি গাজীপুর-২ আসনের এমপি জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমানকেও হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
উঠতি ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
কালিয়াকৈরের যুবলীগ নেতা রফিক হত্যার পর ডিবির উৎপাতে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা, পল্লীবিদ্যুৎ, হরিণহাটিসহ আশপাশের এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। তখন ১৫ দিনে প্রায় দেড়শ লোককে ডিবি আটক করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এক ব্যক্তিকে দুই থেকে তিনবার আটক করার ঘটনাও ঘটেছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় গাজীপুরের শ্রীপুরে এক ইউপি সদস্য প্রার্থীকে কুপিয়ে হত্যা এবং নির্বাচন সংক্রান্ত নানা অভিযোগের পর পুলিশ সুপার হারুনসহ সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে নির্বাচন কমিশন ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল প্রত্যাহার করে।
এছাড়া পুলিশ সুপার হারুনের বিরুদ্ধে গাজীপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ছিলো। এমনকি ব্যক্তি বিশেষকে বিজয়ী করার পরিকল্পনাও ছিল তার। এ উদ্দেশ্যে হারুন জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের তার অফিসে ডেকে নেন এবং কে কে চেয়ারম্যান হবেন, তা তিনি আগেই ঘোষণা দেন। এনিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে হুঁশিয়ার করে দেওয়ারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
নির্বাচনে এসপি ও তার ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা প্রভাব বিস্তার করতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ইসিতে অভিযোগ করেন। এর পর তাদের প্রত্যাহার করে উপযুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন ইসি। সে মোতাবেক তাকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহার করা হলেও মাত্র কয়েকদিনের ব্যাবধানে ইসিকে না জানিয়েই তাকে আবার সেখানেই পদায়ন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যা ছিলো ইউপি নির্বাচন আইনের সরাসরি লঙ্ঘণ। এভাবেই সরকারিভাবে তার অন্যায়ের প্রশ্রয় প্রদান করা হয় অব্যাহতভাবে।
বিরোধী দলীয় চীপ হুইপকে পিটিয়ে পুরস্কৃত ও পদোন্নতি হওয়ার পর তার ঐদ্ধত্য আরো কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপকর্মে সীমা অতিক্রম করেছেন তিনি। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানি করতে তার জুড়ি নেই।
জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা বাবুনগরীকে কোনো প্রকারের নির্দেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই নিজ উদ্যোগে গ্রেফতার করেছিলো হারুনুর রশিদ। এরজন্য তাকে কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। পদোন্নতি পেয়ে গাজীপুর যাওয়ার পর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে দেননি এই কুখ্যাত এসপি।
মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অবশ্যই লগইন করতে হবে।