April 28, 2024, 5:59 am

দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধ : যেসব কারণে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধে জড়াবে না আরব বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই সপ্তাহ। এই কয়দিনে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার ফিলিস্তিনি। মাত্র দুদিন আগেও ইসরায়েলি হামলায় গাজার একটি হাসপাতালে প্রায় ৫০০ লোক নিহত হয়েছে। যদিও ইসরায়েল এই হামলা দায় অস্বীকার করেছে। কিন্তু তাতেই বা কীই আসে যায়। প্রাণহানি, হতাহত যা হওয়ার তা হয়েই গেছে।

গাজাবাসীর ওপর ইসরায়েলের এই বর্বরতার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে জর্ডান, সিরিয়া থেকে সুদূর তিউনিসিয়াও। আজও আরব বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু ২০১৪ সালে হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার ৫০ দিনের যুদ্ধের সময় আরব বিশ্ব যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার থেকে বর্তমানে বেশ কিছু বিষয় আলাদা।

প্রথম যে বিষয়টি ভিন্ন সেটি হলো—আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ২০২০ সালে চারটি আরব দেশ—বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—এক সময়কার বৈরী ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি আরবও উল্লিখিত চারটি দেশের পথেই হাঁটছে। এর আগে মাত্র দুটি দেশ—মিসর ও জর্ডান—ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফলে এসব দেশের গণমাধ্যমেও বর্তমান হামাস-ইসরায়েল সংকট কভার করার ধরন বদলে গেছে।

হামাসের অন্যতম দাতা দেশ কাতারের সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা হামাস-ইসরায়েল সংকটকে বেশ প্রাধান্য দিচ্ছে। সেখানে গাজাবাসীর খবর প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু সৌদি আরবের গণমাধ্যমগুলোকে গ্রহণ করতে হয়েছে কৌশলী অবস্থান। সৌদি গণমাধ্যমগুলো গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন-ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরলেও হামাসকে কভারেজ দিচ্ছে না। কিন্তু প্রায়ই আরবিভাষী ইহুদিদের আলোচনায় ডেকে আনছে। এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনীকে দখলদার বাহিনী বলা হবে কিনা তা নিয়েও সৌদি আরবের গণমাধ্যমগুলোতে বিতর্ক রয়েছে।

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো—বড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা। ২০১৪ সালের যুদ্ধ ফিলিস্তিনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিসরকে উদ্বাস্তু গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিসরীয়দের প্রতিক্রিয়া আগের মতো নয়।

মিসরীয় সমাজের বড় একটি অংশ চায় না গাজার উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে। এ বিষয়ে মিসরের সরকারপন্থী রাজনীতি বিশ্লেষক ইব্রাহিম ঈসা হামাসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আপনারা কেন আপনাদের যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা কেন আপনাদের স্বার্থে ১০ কোটি মিসরীয়র জীবন বিপন্ন করতে চান?’ মিসরীয় সমাজের অন্যান্য পণ্ডিতেরাও প্রায় একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেছেন। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, এটি মিসর সরকারের অবস্থান। কিন্তু বাস্তবতা হলো—মিসরের জনগণের বড় একটি অংশই এমন মনোভাব পোষণ করে।

একই পরিস্থিতি লেবাননেও। বিগত চার বছর ধরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে থাকা লেবাননবাসীর আশঙ্কা করছে, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ হয়তো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। ফলে রাষ্ট্র হিসেবে লেবানন ২০০৬ সালের মতো আবারও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে লেবাননের জনপ্রিয় কলামিস্ট ও ফিলিস্তিনপন্থী সাংবাদিক দিমা সাদেক হামাসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমাদের এই নরকে প্রবেশ করতে বাধ্য করবেন না।’

তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—এই অঞ্চলটি আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভক্ত। উদাহরণ হিসেবে সিরিয়ার কথাই ধরা যাক। দেশটিতে ইসরায়েলবিরোধী মানুষের অভাব নেই। আবার হামাস বিরোধী মানুষেরও অভাব নেই। এর বাইরেও বিগত কয়েক দিনে বিভিন্ন আরব দেশের অনেকেই গাজা ও হামাস সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেছেন, যা কেবল কট্টর ডানপন্থী ইসরায়েলিদের পক্ষ থেকেই শোনা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা জানিয়েছেন, হামাসের জন্য তাদের কোনো সমর্থন নেই। কিন্তু তাঁরা খোলাখুলি বিষয়টি প্রকাশ করতে সাহস পান না।

হামাসের হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ওলট-পালটহামাসের হামলায় মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতি ওলট-পালট
বিপরীত চিত্রও আছে, যেমন ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনার আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি এমনটা করেছেন, কারণ তার দেশের সাধারণ জনগণ এখনো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে। জনরোষ কমাতে তিনি হয়তো এ ধরনের আচরণের আশ্রয় নিয়েছেন।

আবার জর্ডান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমা হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ ইস্যুতে বাইডেন ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল করেন। এর কারণও একটি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জর্ডানের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ প্রশমন।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হামাসের পরবর্তী চাল কী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হামাসের পরবর্তী চাল কী
আরব বিশ্বের জনসাধারণের মনে চলমান যুদ্ধ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণের একটি কারণ হলো—ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা। অনেক বিশ্লেষকই ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণকে ১৯৭৩ সালের ইয়াম কিপ্পুরের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সর্বশেষ সেবারই ইসরায়েল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিল।

তবে ১৯৭৩ সালে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চালিয়েছিল, তা দেশটির জন্য অস্তিত্বের সংকট ছিল। সে সময় ইসরায়েল আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও চিন্তাভাবনা করেছিল। সেই ঘটনার ৫০ বছর পর সেই ইসরায়েলকেই যুদ্ধে টেনে নামিয়েছে কোনো দেশ নয়; স্রেফ একটি সশস্ত্র সংগঠন। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক একটি অনারব দেশ। ফলে এই সংকটের প্রকৃতি কোনোভাবেই ইয়াম কিপ্পুরের যুদ্ধের সময়কার ঘটনার মতো নয়।

ইসরায়েলের জন্য এই যুদ্ধ হয়তো অস্তিত্বের সংকট নয়, কিন্তু অনেক আরব দেশের বিদ্যমান ‘ভঙ্গুর’ রেজিমের জন্য হানিকর হয়ে উঠতে পারে এই যুদ্ধ। এ বিষয়ে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেন, যুদ্ধে লেবানন জড়িয়ে পড়বে কিনা সে বিষয়ক সিদ্ধান্ত আসলে তাঁর হাতে নেই। মিসর ও জর্ডানের শাসকেরা চাইবেন না এই যুদ্ধে তাদের দেশ জড়িয়ে পড়ুক। কারণ তাতে তাদের ক্ষমতার তখত কেবলই নাজুকই হয়ে উঠবে। আবার উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোও চাইবে না হামাসের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইরানকে চটাতে। সে ক্ষেত্রে ইরানের হয়ে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে আশপাশের অনেক গোষ্ঠীই তাদের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ আরব রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক উভয়সংকট নিয়ে হাজির হয়েছে।

অনুবাদ:দৈনিক আজকের পত্রিকা


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন


ফেসবুকে আমরা