ডেস্ক রিপোর্ট।।
প্রান্তিক মানুষদের মাঝে ছাগল পালনে আগ্রহ বাড়িয়ে দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’ হাতে নেয় সরকার। ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে খামারি বাছাই, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই দায়সারাভাবে শেষ করেছেন প্রকল্প পরিচালক। উঠেছে কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগও। সূত্র – আজকের পত্রিকা
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের ২৩টি জেলার ১৯৭টি উপজেলায় এটি বাস্তবায়িত হয়। শুরুর দিকে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে হয় ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সম্পন্ন হয় ২০২২ সালের জুনে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় হাজার ছাগল খামারিকে তিন দিনের আবাসিক ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৫৭০ জন খামারিকে একটি করে বিজ্ঞানসম্মত মাচাযুক্ত ছাগলের মডেল শেড বা ঘর, ছাগলের বাচ্চার পুষ্টি নিশ্চিতকরণে মিল্ক রিপ্লেসার (ফর্টিফাইড মিল্ক পাউডার), কৃমিনাশক ও অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জাত উন্নয়নের জন্য প্রান্তিক খামারিদের পালিত পাঁঠার মধ্য থেকে সঠিক কৌলিক মানসম্পন্ন ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের পাঁঠা চিহ্নিত করে প্রতি উপজেলায় একজনকে একটি বিজ্ঞানসম্মত মাচাযুক্ত ছাগলের মডেল শেড বা ঘর দেওয়া হয়েছে। এসব পাঁঠার ব্রিডিং রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কিন্তু মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিবেদনে উল্লেখ করা এসব কাজের প্রায় সব কটিই দায়সারাভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণ পাননি প্রকৃত খামারিরা। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বড় অংশই খামারি নন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানান, খামারিদের ছাগল পালনের বিভিন্ন বিষয়ে হাতেকলমে শেখানোর কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণের বেশির ভাগই খামারি ছিল না। প্রশিক্ষণে একটি ব্যাগ, সার্টিফিকেট ও ১ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। প্রকৃত খামারিরা এই প্রকল্পের কোনো সুফল পাননি। প্রকল্পের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার পকেট গরম হয়েছে।
২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রকল্পের ৫০ জন কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং ফার্মারকে (সিজিএফ) তিন দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই তালিকা ধরে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা প্রশিক্ষণে ছিলেন না। অনুদান পাওয়া কয়েকজন ব্যক্তির খামার নেই। আবার অনেকে ছাগল পালন করেন না। ন্যূনতম ৫টি ছাগল পালন করা খামারিদের প্রশিক্ষণে মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র ১টি ছাগল থাকা ব্যক্তি। আবার ২৫টির বেশি ছাগল পালনকারী খামারি জানতেই পারেননি প্রশিক্ষণের বিষয়ে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিবেদনের তালিকা অনুযায়ী কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দক্ষিণ শশীদল গ্রামের মোর্শেদা বেগম প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু মোর্শেদার স্বামী মো. রেহানুল ইসলাম জানান, কোনো প্রশিক্ষণে অংশ নেননি তাঁর স্ত্রী।
রেহানুলের ২৫টি ছাগল থাকলেও পাননি প্রশিক্ষণের ডাক। উল্টো প্রকল্পের পক্ষ থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কয়েকজন লোক এসে ২৫টি ছাগলকে ভ্যাকসিন দেন। পরের দিন ১২টি ছাগল মারা যায়। ভয়ে বাকি ছাগলগুলো তড়িঘড়ি বিক্রি করে দেন রেহানুল। বর্তমানে তাঁর খামার নেই।
জেলার চান্দিনা উপজেলার পূর্ব রামচন্দ্রপুর গ্রামের আবুল বাশার জানান, তাঁর ২টা ছাগল আছে। কিন্তু তিনিও ওই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। পেয়েছেন ১ হাজার টাকা আর একটা ব্যাগ। যদিও ন্যূনতম ৫টি ছাগল পালন করা খামারিদের এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার কথা।
কর্মী নিয়োগ সুপারিশে
প্রকল্পের অধীনে ১৯৭ উপজেলায় ১ জন করে মোট ১৯৭ জন গোট ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কার (জিডিডব্লিউ) নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের শর্তে যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রার্থীদের অগ্রাধিকারের কথা বলা হলেও ৮০ শতাংশ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সুপারিশের ভিত্তিতে। ২০১৯ সালের ২০ মার্চ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ইস্যু করা স্মারকে দেখা যায়, ১৭ জনের মধ্যে ১১ জনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
২০২০ সালের জানুয়ারির এক স্মারকে জিডিডব্লিউ নির্বাচনের মানদণ্ড অনুযায়ী ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে নিয়োগ পাওয়া ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। মাত্র দুজন অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ ছাড়াই নিয়োগ পান।
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া এক জিডিডব্লিউ বলেন, ‘স্বজনপ্রীতি আর নিজস্ব লোক ছাড়া প্রকল্পে নিয়োগ হয়নি। অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ দিয়ে প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য কখনোই পূরণ সম্ভব নয়। অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে টিকা করানো ভয়ংকর। কয়েক জায়গায় ছাগল মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।’
নির্মাণকাজে অনিয়ম
প্রকল্পের অধীনে নির্মাণকাজের ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে প্রকল্পের অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। রাজশাহীর রাজাবাড়ীহাট ছাগল উন্নয়ন খামারের সংস্কার ও উন্নয়নকাজের কিছু ভিডিও এবং ছবি আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পুরাতন রড। সুমন নামের এক রাজমিস্ত্রি রডের খাঁচা তৈরি করেছেন। ইট ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের। ইটের খোয়াও ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের, যা ঢালাইয়ের কাজে অনুপযুক্ত।
রাজমিস্ত্রি সুমন বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক যেভাবে কাজ করতে বলেছেন, সেভাবে করেছি। আমাদের কিছুই করার নাই। আমরা ভালো মানের জিনিস পেলে তাই দিয়ে কাজ করি। খারাপ দিলেও করার কিছু থাকে না। আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবেন না।’
খামারের কাজের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন রাজাবাড়ীহাট ছাগল খামারের পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। গত বছর অবসরে গেছেন তিনি।
জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক যেভাবে কাজ করিয়ে নিয়েছেন, সেভাবেই হয়েছে। রডের বদলে বাঁশ দেওয়া হয়নি। আর যেসব পুরোনো ও অচল ইট ছিল, সেগুলো পরে বাদ দিয়ে নতুন ইট আনা হয়েছিল। যেভাবে কাজের হুকুম দেওয়া হয়, সেভাবেই কাজ হয়।’
ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পে সব অনিয়মের জন্য প্রকল্প পরিচালক শরিফুল হককে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে তিনি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের খামার বিভাগের উপপরিচালক।
প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে শরিফুল হককে অনেকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।