June 26, 2025, 9:30 pm
সর্বশেষ:
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারেক রহমান: এক আলোকচ্ছটা ডেঙ্গু প্রতিরোধে দরকার গবেষণাভিত্তিক ও সমন্বিত উদ্যোগ শুধু শহর নয়, সংবাদপত্রে গ্রামও প্রয়োজন সমানভাবে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাওয়ায় সাংবাদিকের সাথে দুর্ব্যবহার প্রকল্প কর্মকর্তার! রাজনীতিতে অতি উৎসাহী কর্মীদের কবলে অপার সম্ভাবনার নেতৃত্ব: একটি গভীর বিশ্লেষণ ডেমরায় আইনশৃঙ্খলার অবনতির নেপথ্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও গ্যাং সংস্কৃতি মেঘনার গোবিন্দপুর ইউনিয়নে সামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি মেঘনায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে অনিয়ম রোধে প্রশাসনের ভূমিকা জোরালো করতে হবে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি মেঘনা উপজেলায় মাদকের আগ্রাসন: ধ্বংসের পথে যুবসমাজ

রাজনীতিতে অতি উৎসাহী কর্মীদের কবলে অপার সম্ভাবনার নেতৃত্ব: একটি গভীর বিশ্লেষণ

বিপ্লব সিকদার :

রাজনীতি একটি বহুমাত্রিক চর্চার নাম। এখানে নেতৃত্বের গুণাবলি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নেতৃত্বকে ঘিরে থাকা কর্মীবাহিনীর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। একজন নেতা যতই দূরদর্শী হোন না কেন, যদি তার চারপাশে এমন একদল কর্মী থাকে যারা অন্ধ সমর্থক, চাটুকার বা তথাকথিত ‘অতি উৎসাহী’, তাহলে সেই নেতৃত্ব সময়ের ব্যবধানে কার্যকারিতা হারায়। বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই চিত্রটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং দিন দিন উদ্বেগজনকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে।

অতি উৎসাহ: সমস্যা না সমাধান?

অতি উৎসাহী কর্মীদের দেখা যায়, তারা দলীয় নেতার প্রতি এমন এক ধরনের অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করেন, যেখানে সমালোচনা, ভিন্নমত কিংবা যুক্তিভিত্তিক প্রশ্নের কোনো স্থান থাকে না। তারা ভাবেন, নেতার গৌরব প্রচার করাই একমাত্র রাজনৈতিক দায়িত্ব। ফলে তারা নেতা বা নেতৃত্বের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়—এমন যে কোনো কথা, প্রশ্ন বা বিশ্লেষণকে বিদ্বেষ হিসেবে দেখেন এবং সেটি দমন করতে তৎপর হয়ে ওঠেন।

এই অতি উৎসাহের ফলেই রাজনৈতিক দলে একটি সংকীর্ণ বলয় তৈরি হয়। এই বলয় এমন এক প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র, উন্মুক্ত মতবিনিময় কিংবা নেতৃত্বের মূল্যায়নের সুযোগ আর থাকে না। ফলে যারা সত্য কথা বলতে চান, তারা একে একে পিছিয়ে যান, নেতৃত্ব একঘরে হয়ে পড়ে এবং অপার সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব মুখ থুবড়ে পড়ে।

নেতৃত্ব হারায় গতি ও দূরদর্শিতা

নেতৃত্বের সাফল্য নির্ভর করে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কৌশল নির্ধারণ, এবং জনগণের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরির ওপর। কিন্তু যখন সেই নেতৃত্ব দিনের পর দিন অতি উৎসাহী কর্মীদের ঘেরাটোপে বন্দি থাকে, তখন সে তার দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তার কাছে পৌঁছায় না, তৃণমূলের ভাষা তার কাছে অজানা থেকে যায়। সিদ্ধান্তগুলো হয় বলয়কেন্দ্রিক, বাস্তবতাবিবর্জিত এবং জনসম্পৃক্ততা শূন্য।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। একজন প্রতিশ্রুতিশীল নেতা যখন উঠতে শুরু করেন, তখনই কিছু ‘বিশ্বস্ত’ কর্মী তাকে ঘিরে ধরেন। শুরু হয় বাহবা, চাটুকারিতা, প্রতিপক্ষকে হেয় করা—আর এর মধ্য দিয়েই একসময় সেই নেতাও নিজের মূল্যায়ন করার জায়গা হারিয়ে ফেলেন। তার চারপাশে তৈরি হয় ‘অসত্যের দেয়াল’। দিন শেষে তিনি হয়ে ওঠেন একটি বলয়ের প্রতিনিধি, জনগণের নয়।

দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষয় ও ভবিষ্যৎ সংকট

রাজনীতিতে প্রতিভার মূল্যায়ন, অভিজ্ঞতার ব্যবহার এবং নতুন নেতৃত্ব গঠনের একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা থাকা জরুরি। কিন্তু অতি উৎসাহী কর্মীরা যখন এসব সম্ভাবনাকে থামিয়ে দেয়, তখন দলের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে। যে দল বা নেতৃত্ব নিজের চারপাশের বলয় ভাঙতে পারে না, সে কোনোদিনই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে পারে না। তৃণমূলের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, জনপ্রিয়তার অভাব, এবং কৌশলগত দুর্বলতা তাকে ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে।

এমনকি দলীয় কোন্দল, বিভক্তি এবং ভাঙ্গনের পেছনেও এই অতি উৎসাহীদের বড় ভূমিকা থাকে। তারা প্রতিযোগিতামূলক চিন্তার পরিবর্তে পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান নেয়, যোগ্যদের বদলে ‘নিজেদের লোক’কে তুলে ধরতে চায়, এবং দলীয় অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। দীর্ঘ মেয়াদে এসব কাজ দলের ভিত দুর্বল করে দেয়।

সমাধান কোথায়?

১. নেতৃত্বের আত্মসমালোচনার মানসিকতা থাকা জরুরি: একজন যোগ্য নেতা কখনোই নিজেকে সবজান্তা মনে করেন না। তাকে এমন কর্মীদের আশেপাশে রাখতে হবে যারা কেবল বাহবা দেবে না, বরং দরকারে ভুল ধরিয়ে দেবে।

2. সংগঠনে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করা: রাজনৈতিক দলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শৃঙ্খলার ভারসাম্য থাকতে হবে। দমন নয়, যুক্তির মাধ্যমে দ্বিমতের জবাব দিতে হবে।

৩. মূল্যায়নভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন: কর্মীদের পদায়ন, দায়িত্ব ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রগুলো যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। অন্ধ আনুগত্যকে পুরস্কৃত করলে দলের ক্ষতিই হয়।

৪. নেতৃত্বের চারপাশে স্বচ্ছ ও বিকল্প চিন্তাশীল বলয় তৈরি করা: এটা নেতৃত্বের সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

 

 

পরিশেষে বলা যায় রাজনীতি কেবল জনপ্রিয় স্লোগান বা জনসভা নির্ভর চর্চা নয়—এটি একটি কাঠামোগত, নীতিনিষ্ঠ ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার জায়গা। অতি উৎসাহী কর্মীদের অন্ধ আনুগত্য, চাটুকারিতা ও দমননীতির কারণে সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব হারিয়ে যেতে বসেছে—এটা আমাদের অনেক রাজনৈতিক দলের বাস্তবতা। এখন সময় এসেছে অতি উৎসাহ নয়, যুক্তিবোধসম্পন্ন ও সংগঠনতান্ত্রিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে নেতৃত্বকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার। তাহলেই রাজনীতি হবে জনবান্ধব, নেতৃত্ব হবে স্থায়ী, আর সংগঠন হবে শক্তিশালী।

 

লেখক – ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মাসিক বনফুল, বিন্দুবাংলা টিভি 


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা