বিপ্লব সিকদার :
রাজনীতি হল নেতৃত্ব, জনসেবা ও নৈতিকতার পথ। কিন্তু যখন নেতৃত্বের আসনে বসা কেউ নিজ অনুসারীদের মাধ্যমে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করতে ‘ইঙ্গিত’ দেন, তখন বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় শুধু রাজনৈতিক নয়, একটি সামাজিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিতও। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে, রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের মধ্যে এমন এক বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—নিজেরা সরাসরি হামলা বা হুমকি না দিলেও, কথার আড়ালে কিংবা ‘চোখের ভাষায়’ উসকে দিচ্ছেন তাদের উগ্র কর্মীদের। ফলে তৈরি হচ্ছে ভয়, বিভ্রান্তি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
ইঙ্গিতের ভাষা: হঠাৎ নয়, পরিকল্পিত
রাজনৈতিক সভা, পার্টি অফিস অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতার কিছু ‘দিকনির্দেশনা’ বা ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য কখনো কখনো কর্মীদের মাঝে স্পষ্ট বার্তা হিসেবে পৌঁছে যায়—‘কাকে টার্গেট করতে হবে’, ‘কাকে শান্ত রাখতে হবে’ বা ‘কাকে শিক্ষা দিতে হবে’। এটিকে কখনো সরাসরি বলা হয় না। কিন্তু দলের সক্রিয় কর্মীরা ‘নেতার ভাষা’ বুঝে নিতে দারুণ পারদর্শী।
এই ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়, অন্যদিকে নেতার নিজের দায়দায়িত্ব থেকেও তাকে কার্যত মুক্ত করে দেয়। তিনি একদিকে নিজেকে ‘ভদ্রলোক রাজনীতিক’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, অন্যদিকে নিজের ‘বাহিনী’ দিয়ে প্রতিপক্ষকে দমন করান।
আইন কী বলে?
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৫ ধারায় “গুজব ছড়ানো বা উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান” দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। একইসঙ্গে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অসতর্কভাবে এমন কিছু বলেন বা করেন যার ফলে সহিংসতা ঘটে, তা আইনের চোখে উসকানি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে, বক্তা বা ইঙ্গিতদাতা সরাসরি ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
নেতৃত্ব মানেই দায়, নির্দেশ নয়
একজন প্রকৃত নেতা জনতাকে শান্ত রাখেন, পরিস্থিতি ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন। তিনি জানেন, একবার উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে গেলে তা দল বা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অথচ আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব রক্ষার জন্য অপপ্রচারের মাধ্যমে চরিত্র হনন করছেন, আবার কেউ মঞ্চে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সাংবাদিকের প্রতি ‘প্রকাশ্যে তর্জনী’ তুলছেন। তারপরে শুরু হয় হামলা, হুমকি, এমনকি চরম অপমানের পালা।
প্রশ্ন হলো—যদি নেতা স্বয়ং সহিংসতার প্ররোচক হন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার কী?
প্রশাসনের নীরবতা: দায় এড়ানো নয়
এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের দায়িত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। শুধু ভুক্তভোগীর জিডি নেয়া বা সাধারণ তদন্ত নয়, প্রশাসনকে নিজ উদ্যোগে তদন্ত করতে হবে—নেতার বক্তব্য, ঘটনার পূর্বাপর তথ্য, দলীয় কর্মীদের গতিবিধি সব কিছু। না হলে একের পর এক ‘নেতার ইঙ্গিতে কর্মীর মার’, ‘চোখের ভাষায় বিচার’, ‘মব-তাণ্ডব’ চলতেই থাকবে।
সমাজের যে ক্ষতি হয়
এই ধরণের রাজনৈতিক মব কন্ট্রোলের কারণে:
ভিন্নমত দমন হয়,
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়,
সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা শঙ্কিত হয়,
এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় গণতন্ত্রের ভিত্তির।
যেখানে রাজনীতি হওয়া উচিত নীতির ভিত্তিতে, সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার, হুমকি, সন্ত্রাস এবং ত্রাসের মাধ্যমে যারা রাজনীতি করেন, তারা সমাজকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থির করে তোলেন।
শেষ কথা হলো নেতা মানেই বড় দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যদি হয় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের ইন্ধন দেওয়া—তাহলে সেই নেতৃত্ব কেবল ব্যর্থই নয়, তা অপরাধেরও শামিল। নেতৃত্বের মুখোশ পরে কেউ যদি সন্ত্রাসের নাটের গুরু হয়ে ওঠেন, তবে তা সমাজ, রাষ্ট্র ও আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর বার্তা।
(বিজ্ঞাপন)
লেখক : রাজনীতিক, সাংবাদিক।