July 4, 2025, 6:24 pm

জুলাইয়ে গণতন্ত্রের ডাক, এখন কেন ‘মার্কা’ তান্ত্রিক পদ্ধতির খোঁজ?

বিপ্লব সিকদার :

২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজপথে যে গণজোয়ার দেখা গিয়েছিল, তা নিছক একটি আন্দোলন ছিল না—ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক সংগ্রামী ডাক। সেই ডাকের পেছনে ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, দমন-পীড়নের অভিজ্ঞতা, ভোটাধিকার হারানোর বেদনা, আর ছিল একটি স্বপ্ন—একটি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা।

কিন্তু আজ, যখন সেই বিপ্লবের প্রাথমিক দাবিগুলোর বাস্তবায়নই পুরোপুরি হয়নি, তখন নতুন করে প্রস্তাব আসছে—দেশে প্রচলিত প্রথম-পূর্বগামী (First Past the Post) পদ্ধতির পরিবর্তে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর।

প্রশ্ন হলো, জনগণ কি এই পদ্ধতির জন্য রক্ত ঝরিয়েছে? নাকি তারা চেয়েছিল এককেন্দ্রিক ক্ষমতার অবসান, দলে নয়—ব্যক্তির মাধ্যমে সরাসরি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার সুযোগ?

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যে বিপ্লব

জুলাই মাসে জনগণ যে উত্তাল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তা মূলত একটি জনগণের অভ্যুত্থান ছিল—নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার দাবি নিয়ে। সেই বিপ্লবের মূল স্পিরিট ছিল:

> “নির্বাচনে মানুষ ভোট দেবে, দল নয়—প্রার্থী বেছে নেবে ব্যক্তির যোগ্যতা ও আস্থার ভিত্তিতে।”

 

এখন কেন PR পদ্ধতির আহ্বান?

PR পদ্ধতি মূলত এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সংসদে আসন পায়। এতে করে দলীয় মার্কার গুরুত্ব বাড়ে, ব্যক্তির পরিচয় বা স্থানীয় জনপ্রিয়তা গৌণ হয়ে পড়ে। এটি উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কার্যকর হলেও, আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দুর্বল, সেখানে এটি হতে পারে একধরনের নতুন দলতন্ত্রের ফাঁদ।

প্রকৃতপক্ষে, PR ব্যবস্থা আমাদের প্রেক্ষাপটে—

দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে অধিক ক্ষমতাশালী করে তোলে

মনোনয়ন বাণিজ্য ও অনুগতদের সুবিধা দেয়

সরাসরি জনগণের সঙ্গে প্রার্থীর সংযোগ দুর্বল করে

স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা ও দায়বদ্ধতা হ্রাস করে

‘মার্কা’ তান্ত্রিকতা বনাম গণতান্ত্রিকতা

একটি জনগণের রাষ্ট্রে যেখানে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা লক্ষ্য, সেখানে PR পদ্ধতির চেয়ে প্রয়োজন উন্নত FPTP ব্যবস্থা, যেখানে থাকবে—

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন

নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ

দলীয় নয়, ব্যক্তিগত দক্ষতা ও জনসংযোগের ভিত্তিতে ভোট

নির্বাচিত প্রতিনিধির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা

আমরা যদি গণতন্ত্রে আস্থা রাখি, তাহলে আমাদের পথ হওয়া উচিত—জনগণের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, দলীয় নিয়ন্ত্রণ নয়।

জুলাই বিপ্লব কি ভুল পথে মোড় নিচ্ছে?

এখনকার পরিস্থিতি দেখে অনেকেই আশঙ্কা করছেন—যদি PR পদ্ধতির মতো ‘মার্কাভিত্তিক’ তান্ত্রিক প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়, তবে জুলাই বিপ্লবের চেতনা ও জনগণের স্বপ্ন ব্যর্থ হবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হবে, আর জনগণ আবারও প্রান্তিক হয়ে পড়বে।

স্মরণ রাখা দরকার—গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, বরং একটি মূল্যবোধ, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশ, অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য।
জুলাইয়ে যারা রাস্তায় নেমেছিলেন, তারা চেয়েছিলেন একটি ভিন্ন বাংলাদেশ—যেখানে দল নয়, ব্যক্তি মুখোমুখি হবে জনগণের; যেখানে ভোট মানে হবে জনসমর্থনের প্রতিফলন, কৌশলগত আসন বণ্টন নয়। সেই স্বপ্ন যদি দলীয় PR পদ্ধতির ভেতর ডুবে যায়, তবে এটি হবে আরেকটি রাজনৈতিক ছলনা—আরেকটি গণমানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যাত্রা শুরু হয়েছে, এখন দরকার সেই পথটিকে সৎ ও স্বচ্ছ রাখা। “মার্কা-তন্ত্র” নয়, চাই মানবতন্ত্র, অংশগ্রহণতন্ত্র, এবং প্রকৃত গণতন্ত্র।

লেখক : সাংবাদিক।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা