বিপ্লব সিকদার :
মেঘনা উপজেলার মানুষ আজও গর্ব করে বলে তাদের জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মেঘনা ও কাঠালিয়া নদী বেষ্টিত এ অঞ্চলটি এক সময় ছিল বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল। সেই সময় থেকেই এখানকার মানুষের মূল পেশা কৃষি ও মাছ শিকার। সময়ের পরিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়া এলেও, পরিবর্তন আসেনি নদীতে মাছ ধরার প্রাচীন পদ্ধতিতে ‘ঝোপ’ বা ‘ঝাঁক’ পাতা এখনো এখানে প্রথা হিসেবে চালু আছে।
তবে এই প্রথাই এখন নদীর জন্য অভিশাপ। প্রকৃত জেলেরা যেভাবে মাছ ধরে, এই ঝোপের ব্যবসা তেমন নয়। এটি এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি একেকটি ঝোপ নদীর বিশাল অংশ দখল করে ফেলে, যেখানে সাধারণ জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ হারায়। ফলে নদী হয়ে উঠছে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন একেকটি খামার।
বিগত ১০ বছর ধরে মেঘনা উপজেলা প্রশাসনের মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় বারবার এই অবৈধ ঝোপ ব্যবসার কথা বলা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এক–দু’বার নামমাত্র অভিযান চালিয়ে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে সব। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বারবার বললেও, কেউই স্থানীয়দের বোঝাতে পারেননি যে “সংস্কৃতি” নয়, এটি এখন নদী ও পরিবেশের জন্য অপরাধ।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ঝোপের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এলাকার জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশীজন। ফলে প্রশাসনও কার্যত অসহায়। অনেক সময় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সাময়িক আলোচনার ঝড় ওঠে, কিন্তু কিছুদিন পর সব থেমে যায়। ঝোপের জ্বালা থেকে মুক্তি মেলে না নদীর, না জেলেদের।
একটি ঝোপ বসাতে কয়েক লক্ষ টাকা লাগে—অর্থাৎ এটি এখন মূলত এক শ্রেণির পুঁজি বিনিয়োগের ব্যবসা। সাধারণ জেলেরা এর বাইরে। অথচ নদীর আসল রক্ষক তারাই। কিন্তু যাদের হাতে নদী রক্ষার দায়িত্ব, তারাই আজ অপরাধের বৈধতা দিচ্ছেন “সংস্কৃতি” বলে।
এই তথাকথিত ঐতিহ্য যদি এখনই বন্ধ না করা হয়, তাহলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হবে, মাছের প্রজনন কমবে এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি ঘটবে। প্রশাসনের উচিত হবে শুধু অভিযান নয়, জনসচেতনতা সৃষ্টি করে এই প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
না হলে, বারবারই সত্য হবে সেই প্রবাদ
“যত লেখা-লেখিই হোক, বন্ধ হবে না ঝোপের রাজত্ব,
মধু পান করবে যদু—আর নদী মরবে নিঃশব্দে।”