• বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২৯ পূর্বাহ্ন
  • [gtranslate]

যে রাষ্ট্র আজ নিজেই অনাথ

বিপ্লব সিকদার / ৫৬ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশের সময় : বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫

রাষ্ট্র সাধারণত কাঁদে না। রাষ্ট্র শোক প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপনে, কালো ব্যাজে, আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। আজ এই রাষ্ট্র নিজেই অনাথ। কারণ আজ এমন একজন মানুষের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছে দেশ—যিনি রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকেও রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার সাহস জাগিয়ে রেখেছিলেন।
আজ জাতি কাঁদছে দেশমাতার জন্য। কিন্তু এই কান্না কোনো আনুষ্ঠানিক শোক নয়, কোনো দলীয় শোকসভাও নয়। এটি একটি রাজনৈতিক শূন্যতার কান্না যে শূন্যতা পূরণ হওয়ার মতো নয়, অন্তত এখনই নয়।গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে রাজনীতি ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে। মত প্রকাশ সীমিত হয়েছে, ভিন্নমত অপরাধে পরিণত হয়েছে, আর আপোষই হয়ে উঠেছে টিকে থাকার একমাত্র শর্ত। ঠিক এই বাস্তবতার ভেতরেই একজন মানুষ ছিলেন, যিনি আপোষ না করার মূল্য বারবার দিয়েছেন—কারাবরণে, অসুস্থতায়, নিঃসঙ্গতায়।বেগম খালেদা জিয়া তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন ছিলেন না; তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের ভেতরে থাকা একটি বিবেক, যা প্রশ্ন করত—ক্ষমতা কি সীমাহীন হতে পারে? রাষ্ট্র কি মানুষের ঊর্ধ্বে?আজ সেই প্রশ্নকর্তা কণ্ঠ স্তব্ধ।গ্রামের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা দিনমজুর জানে না সংবিধানের ধারা। কিন্তু সে জানত—এই দেশে অন্যায় হলে কেউ একজন অন্তত মুখ খুলেছে। আজ সে মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাঁদছে। শহরের মধ্যবিত্ত জানে, তার জীবনযাত্রা কালও কঠিন ছিল, আজও কঠিন থাকবে। তবু তার বুক ভারী—কারণ সে বুঝছে, প্রতিরোধের প্রতীকগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
এই কান্না রাজনীতির নয়—এই কান্না গণতন্ত্রের।
কারণ গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনের নাম নয়। গণতন্ত্র হলো ভয় না পাওয়ার সাহস, ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সক্ষমতা। আজ সেই সক্ষমতার একটি বড় স্তম্ভ ভেঙে পড়েছে।গত বছরগুলোতে রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল কঠোর, প্রায় নির্দয়। বিরোধিতা মানেই রাষ্ট্রবিরোধিতা এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধীরে ধীরে। ঠিক সেই সময় একজন মানুষ ছিলেন, যিনি নিজের শরীর দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বাস্তবতা বহন করেছেন। তার অসুস্থ শরীর ছিল একটি জীবন্ত দলিল—ক্ষমতা কীভাবে বিরোধী কণ্ঠকে নীরবে ভেঙে দিতে চায়।
আজ সেই শরীর আর নেই। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে—রাষ্ট্র কি তার শিক্ষা নেবে?আজ ক্ষমতার করিডোরে নীরবতা। প্রকাশ্যে শোক, ভেতরে হিসাব। রাজনীতি এমনই। কিন্তু রাজনীতির বাইরে থাকা মানুষগুলো আজ অসহায়। তারা বুঝতে পারছে, সামনে দিনগুলো আরও কঠিন হবে। কারণ রাজনীতিতে যখন আপোষহীনতার জায়গা কমে যায়, তখন সাধারণ মানুষের জায়গাও সঙ্কুচিত হয়।এই প্রতিবেদনের ভাষা হয়তো কারও কাছে অতিরঞ্জিত মনে হবে। কিন্তু যারা মাঠের রাজনীতি দেখেছেন, মামলা-হামলা দেখেছেন, যারা দেখেছেন কীভাবে ভিন্নমত ধীরে ধীরে অপরাধে পরিণত হয়েছে তারা জানেন, আজকের শোক আসলে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পরিণতি।
একজন মানুষের মৃত্যু কখনোই শুধু ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, যদি সেই মানুষটি একটি ধারণাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। আজ যে ধারণাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার নাম ‘না বলার অধিকার’।আজ রাষ্ট্র শক্তিশালী। প্রশাসন কার্যকর। আইন আছে, আদালত আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের শক্তি তখনই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, যখন তার সামনে দাঁড়ানোর মতো কেউ থাকে না। আজ মানুষ সেই শঙ্কাতেই কাঁদছে।
এই কান্না হয়তো আজ কোনো জাতীয় দৈনিকে পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হবে । কারণ এটি সরাসরি কাউকে অভিযুক্ত করছে না, আবার কাউকে মুক্তিও দিচ্ছে না। এটি শুধু একটি বাস্তবতা তুলে ধরছে রাষ্ট্র যখন একজন আপোষহীন মানুষকে হারায়, তখন রাষ্ট্র নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ে।দেশ আজ শোকাহত। কিন্তু এই শোক যদি কেবল আবেগে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ইতিহাস ক্ষমা করবে না। কারণ আজকের কান্না আসলে একটি সতর্কবার্তা—যে রাষ্ট্র প্রশ্নহীন হয়ে পড়ে, সে রাষ্ট্র একদিন নিজেকেই হারায়।আজ দেশমাতার জন্য কান্না করছে জাতি।
কিন্তু এই কান্না যদি অধিকার আদায়ের  প্রতিবাদে,ইতিবাচক শক্তিতে  রূপ না নেয়, তবে আগামীকাল এই কান্নাই হবে স্বাভাবিক শব্দ।

লেখক -সাংবাদিক।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।

এই জাতীয় আরো খবর দেখুন