July 6, 2025, 9:20 am

আন্দোলনের আগুনে গড়া এক ছাত্রনেতা নাজমুল হাসান

 

নাঈমুল হাসান :

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে এই জুলাইয়ে। কোটা সংস্কার থেকে শুরু হয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে রূপ নেওয়া ছাত্র আন্দোলন দেশের রাজনীতিকে করে তুলেছে আলোড়িত। এই আন্দোলনের এক অগ্রভাগে ছিলেন ঢাকা কলেজের গণিত বিভাগের মেধাবী ছাত্র, ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান।

বহু বাধা পেরিয়ে, নির্যাতনের মুখে থেকেও যিনি শুধু দাঁড়াননি—ছাত্র সমাজকে সংঘবদ্ধ করে তুলেছেন, রণচণ্ডী করে তুলেছেন একটি পুরো প্রজন্মকে।

নির্যাতনের ভিতর দিয়েই রাজপথে যাত্রা

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়েই রাজপথে প্রথম সক্রিয় হন নাজমুল। এরপর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভারতীয় আধিপত্যবিরোধী আন্দোলন—প্রতিটি আন্দোলনেই তার দৃপ্ত উপস্থিতি দেখা গেছে। ২০২১ সালে মোদি বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে ভোগ করতে হয়েছে ১৮৩ দিনের কারাবাস।

তবে তা তাকে দমন করতে পারেনি। বরং সেই অভিজ্ঞতাই তাকে আরও বলীয়ান করে তুলেছে।

৫ জুন: আগুনে ঘি ঢালার দিন

২০২৪ সালের ৫ জুন বাতিল হওয়া কোটা পুণরায় চালু হওয়ার খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। ওই দিনই দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি পর্যন্ত মিছিলের নেতৃত্ব দেন নাজমুল। এরপর নীলক্ষেত, ঢাকা কলেজ, সায়েন্সল্যাব—তিন জায়গাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তিনটি শক্ত ঘাঁটি। এই কেন্দ্রগুলোর অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন তিনি।

১৫ জুলাই: লাঠিপেটা, রক্ত, আর প্রতিবাদ

১৫ জুলাই ঢাবি প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলার সময় নাজমুল নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন নীলক্ষেত থেকে টিএসসি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মিছিলে। হলপাড়ায় তার সহযোদ্ধাদের উদ্ধারে গিয়ে ছাত্রলীগের নির্মম হামলার শিকার হন তিনিও। রাস্তায় ফেলে তাকে লাথি, কিলঘুষি মারা হয়, মাথা ফেটে যায়।

তবুও থামেননি। হাসপাতালের বিছানায় থেকেও আন্দোলন পরিচালনায় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।

এই আন্দোলন কোটা নয়, রাষ্ট্র বদলের”

২১ জুলাই প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোটা বাতিল করা হলেও নাজমুল বলেন, “এটা শুধু কোটা আন্দোলন নয়। এটা রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলন।” তার চোখে, এই রাষ্ট্রে অন্যায়, দুর্নীতি আর বৈষম্যের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা শুধুমাত্র একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

শেখ হাসিনার রাজাকার মন্তব্য, ছাত্রদের উপর গণহত্যা, ইন্টারনেট বন্ধ, গ্রেফতার আতঙ্ক—সব মিলিয়ে আন্দোলনের দাবিগুলো রাষ্ট্রপতিসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রতিধ্বনিত হয়।

৫ আগস্ট: পতনের আগুনে গড়া বিজয়

আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে, ৫ আগস্ট, কারফিউর মধ্যে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন নাজমুল। শাহবাগ থানায় এবং সিটিটিসিতে তার উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। চশমা ভেঙ্গে ফেলা, বুট দিয়ে পেটানো, গালিগালাজ—সবই সহ্য করতে হয় তাকে।

কিন্তু বিকেলে চিত্র বদলে যায়। পুলিশ তাকে ক্ষমা চায় এবং ছেড়ে দেয়। তার মুক্তির পর সারা দেশে শিক্ষার্থীরা বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে।

 

ফেসবুক প্রোফাইল লাল, মুখে বাঁধা লাল কাপড়

প্রতীকী প্রতিবাদেও ছিল তার নেতৃত্ব। আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে প্রোফাইল লাল করা, মুখে লাল কাপড় বেঁধে “March for Justice”—এইসব কাজ আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়।

আন্দোলনের ভবিষ্যত: রাষ্ট্র পুনর্গঠনের স্বপ্ন

নাজমুল হাসান বলেন, “আমরা কেবল ছাত্র রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা ইতিহাস গড়তে এসেছি।” তার ভাষায়, এই আন্দোলনের শেষ তখনই হবে, যখন রাষ্ট্রের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বৈষম্য, দলীয়করণ, নিপীড়নের কাঠামো ভেঙে নতুন এক বাংলাদেশ গড়া যাবে।
নাজমুল হাসান এখন আর কেবল একজন ছাত্রনেতা নন। তিনি এক প্রজন্মের প্রতীক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানো, সততা ও সাহসে পথ চলা, এবং নেতৃত্বের সাহসিকতার এক জীবন্ত উদাহরণ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই নাম, এই মুখ এবং এই আন্দোলন বহুদিন পর্যন্ত প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র:
বাসসের সাক্ষাৎকার, মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন ও আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য বন্ধ আছে।


ফেসবুকে আমরা