শাহনাজ রহমান।।
মহানগরীর এক কোণে একসময় খুব আলোচিত ছিলেন জনাব সামিউল কবির। পত্রিকায় কলাম লেখেন, টেলিভিশনে বুদ্ধির ঝলক দেখান, আর বড় বড় সেমিনারে মানুষের জন্য কাঁদেন। সামনের পকেটে সবসময় একটি দামি কলম রাখেন—সোনালী ঝলমলে, যেন সত্যের প্রতীক। তবে কাছের কিছু মানুষ জানত, তাঁর পিছনের পকেটেই থাকে একটি ছোট হাতুড়ি—ধাতব, ভারী, নীরব।
তাঁর কলমে প্রতিবাদ থাকে, কিন্তু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, প্রতিবারই নিরাপদ কাঁটায় গিয়ে থামেন। যেসব অন্যায় নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন, সেসব এড়িয়ে যান পরিপাটিভাবে। মুখে সমাজ বদলাবার কথা, কিন্তু ক্ষমতাবানদের মুখোমুখি হলে হঠাৎ করেই তাঁর কলম চুপসে যায়।
একদিন এক তরুণ লেখক, নাম তার রাশেদ, জনাব কবিরের কাছে যায়। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা ছেলেটি সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখতে চায়, সাহসী লেখা ছাপাতে চায়। সে কবিরকে তার কিছু লেখা দেয়, আশা করে উনি হয়তো সহযোগিতা করবেন।
কবির চুপচাপ লেখাগুলো পড়ে, তারপর মুচকি হেসে বলেন, “ভালো লিখো, তবে… শব্দগুলো একটু বেছে নিও। বিপদ ডেকে আনার দরকার নেই। কলম দিয়ে সমাজ পাল্টানো যায় না, এটা বুঝে নিতে হয়।”
রাশেদ চমকে যায়। যে মানুষটিকে সে আদর্শ ভেবেছিল, তার কণ্ঠে ভয়ের সুর!
রাতের বেলায় রাশেদ শহরের এক কোণে একটি সভায় বক্তৃতা দেয়, “আমাদের সময় এসেছে কলম দিয়ে নয়, কলমে সত্য লিখে সমাজ বদলানোর। যারা কলমের নাম করে হাতুড়ি চালায়, তারা বুদ্ধিজীবী নয়—তারা মুখোশধারী।”
সেই রাতেই রাশেদের ঘরে হানা পড়ে। অজানা কিছু লোক এসে তার পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেলে, মোবাইল ল্যাপটপ ভেঙে দেয়। পুলিশের জিডিতে লেখা থাকে—”রাষ্ট্রবিরোধী উসকানিমূলক লেখা”।
কিছুদিন পর জনাব সামিউল কবির একটি কলাম লেখেন:
“সাম্প্রতিক তরুণদের উগ্র মনোভাব: একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা”
তাতে রাশেদের নাম নেই, কিন্তু ইঙ্গিত সবাই বুঝে।
রাশেদ এখনো লেখে, কিন্তু সে জানে—এ শহরে কলম রাখার মানে শুধু লেখার হাতিয়ার নয়, কখন কাকে হাতুড়ি দিয়ে থামানো হবে, তার সংকেতও।
আর জনাব কবির?
তিনি এখন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আছেন, মাথায় পাগড়ি, হাতে কলম—পেছনের পকেট নিশ্চয়ই এখনো ভারী।