নিজস্ব প্রতিবেদক।।
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় গত এক বছর ধরে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন চলছে যার ফলে স্থানীয় মানুষ, কৃষক ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই অবৈধ কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশাসন জানলেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এক বছরের এই বালু লুট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি তৈরি করেনি, বরং সামাজিক অস্থিরতা এবং পরিবেশগত বিপর্যয়েরও উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, অবৈধ উত্তোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ, হানাহানি, ক্ষতিগ্রস্ত জমি ও ঘরবাড়ি মিলিয়ে প্রায় দুই শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা জানাচ্ছেন, তারা বহুবার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। অভিযানের নামেও একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি।
স্থানীয়দের তথ্য ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বালু ব্যবসায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। আধিপত্য দখলকে কেন্দ্র করে আহত হয়েছেন অনেকে, এবং এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জনমনে প্রশ্ন উঠছে—যখন প্রশাসন এবং স্থানীয়রা জানতেন বালু উত্তোলন হচ্ছে, তা বন্ধ করতে তারা কেন ব্যর্থ হলো? এক বছর পর কেন পদক্ষেপ নেওয়া হলো?
স্থানীয়রা তুলনা করছেন সিলেটের সাদা পাথর লুটের ঘটনার সঙ্গে। তারা বলছেন, যদি সিলেটেও দেরিতে হলেও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে মেঘনায় কেন প্রশাসন উদাসীন? প্রশাসনের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের দৌরাত্ম্য মিলিয়ে এই বালু লুট শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সমাজে অস্থিরতা ও পরিবেশগত বিপর্যয়েরও উদাহরণ তৈরি করেছে।
মেঘনা উপজেলার কৃষিজমি দ্রুত হারানো আর্থিক, সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সঙ্গে যুক্ত। ইটভাটা নির্মাণের জন্য বিশাল পরিমাণ উর্বর জমি খুঁড়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ধোঁয়া এবং দূষণে আশপাশের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবাসন প্রকল্প, বাণিজ্যিক স্থাপনা এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে নদীর পাড় ও উর্বর জমি ভরাট হচ্ছে। অনেক সময় কৃষকরা আর্থিক চাপে বা প্রলোভনে জমি বিক্রি করে দেন। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব এবং ভূমি দখলদারিও কৃষিজমি রক্ষায় বাধা সৃষ্টি করছে।
কৃষিজমি হারালে স্থানীয় ও জাতীয় স্তরে ভোগান্তি বৃদ্ধি পায়। খাদ্য উৎপাদন কমে যায়, কৃষকের জীবিকা বিপন্ন হয়, ভৌগোলিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সামাজিক অস্থিরতাও যুক্ত। কৃষক পরিবারগুলো দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে, এবং অস্থায়ী বা নিম্নপদে চাকরি করতে বাধ্য হয়।বাংলাদেশে কৃষিজমি রক্ষার জন্য আইন আছে। ভূমি ব্যবহার আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন—সবই বিদ্যমান। কিন্তু বাস্তবে এসব আইনের প্রয়োগ দুর্বল। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তা স্থায়ী হয় না। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা ছাড় পেয়ে যান। নিয়মিত মনিটরিং, ভূমি অফিস, কৃষি অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় প্রায় নেই।এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের করণীয় স্পষ্ট। কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। কৃষিজমি কৃষির বাইরে ব্যবহার করলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অবৈধ ভরাট বা স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে হবে, নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে।নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল তৈরি করতে হবে, যাতে কৃষিজমি দখল না হয়। মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে, যেখানে প্রশাসন, কৃষি অফিস, ভূমি অফিস, জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবিদদের সমন্বয় থাকবে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও কৃষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে লাভবান হওয়া যায়, তা জানাতে হবে। ডিজিটাল ভূমি রেকর্ড চালু করতে হবে যাতে দখল ও ভুয়া কাগজপত্র রোধ হয়। স্থানীয় সামাজিক সংগঠন, কৃষক সমিতি ও গণমাধ্যমকে যুক্ত করে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।মেঘনা, নলচর, চালিভাঙ্গা ও ফরাজি কান্দি এলাকায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। এক বছরের এই অবৈধ উত্তোলনের কারণে এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে, সংঘর্ষ ও আহতের সংখ্যা উচ্চ। যেকোনো সময় আবার হতাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলছেন যদি প্রশাসন সিলেট কোম্পানি গঞ্জের সাদা পাথর লুট নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন, তাহলে মেঘনায় বালু লুটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষিজমি ও পরিবেশ রক্ষায় কেন উদাসীনতা? প্রশাসনের তৎপরতা না থাকলে অতীত অপরাধীদের দায় এড়ানো যায় না।সময়ের দাবি হলো প্রশাসন তৎপর হয়ে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করবে, কৃষি ও পরিবেশ রক্ষা করবে এবং মেঘনা উপজেলার জনগণকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করবে। কৃষিজমি রক্ষা মানে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা।